দৈনিকবার্তা- গাজীপুর, ১২ এপ্রিল: জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত দশটা ৩০ মিনিটে এ ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের জন্য আরও একটি নতুন ইতিহাস রচিত হলো। রিভিউ আবেদন খারিজ শেষে দুই দফায় আত্মীয়-স্বজন এবং এক দফায় আইনজীবীদের সাক্ষাতের সুযোগ দিয়ে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬৫ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান। পৈত্রিক এলাকা শেরপুর সদরের কুমরি বাজিতখিলায় ইতোমধ্যে কামারুজ্জামানের দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে স্বজনরা। তার ইচ্ছা অনুযায়ী এ প্রক্রিয়া সারা হয়েছে বলে কামারুজ্জামানের বড় ভাই কফিল উদ্দিন আগেই জানিয়েছিলেন। শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় কামারুজ্জামানকে মৃত ঘোষণা করা হয়, এ কথা বলেছেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী। ফাঁসি কার্যকরের প্রায় সোয়া ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১২টার দিকে জেল ফটকে একথা বলেন তিনি।ফরমান আলী বলেন, রাত সাড়ে দশটায় কামারুজ্জামানের ফাসি কার্যকর করা হয় ও তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।রাত ১১ টা ৪০ মিনিটে যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের লাশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সরাসরি কঠোর পুলিশী অ্যাম্বুলেন্স করে নিরাপত্তায় নেওয়া হয় শেরপুরে, সেখানে পৈত্রিক এলাকায় তার দাফনের প্রস্তুতি নেয় পরিবার। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর একাত্তরের আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের মরদেহ নেওয়া হচ্ছে শেরপুরের গ্রামের বাড়িতে। শনিবার (১১ এপ্রিল) রাত সাড়ে এগারটা ৪০ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্সবাহী মরদেহ রওনা হয়েছে শেরপুরের উদ্দেশ্যে।শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদীপাড়া গ্রামের বাড়িতে তার নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে। কারাগারের ভেতর থেকে বের করার পর প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে মরদেহ। রাত দশটার পরে এ ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশের জন্য আরও একটি নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। এরপর প্রায় বিশ মিনিট ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা হয় কামারুজ্জামানকে। পরে মরদেহ নামিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় দু’পায়ের রগ কেটে। সবশেষে মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কামারুজ্জামানের মরদেহ কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে চড়িয়ে বের করে আনা হয়। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয় শেরপুরে। পুলিশের নিরাপত্তা দানকারী গাড়ি ছাড়াও আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে মরদেহের সঙ্গে। র্যাব, পুলিশ, ঢাকা মহানগর পুলিশ, ঢাকা জেলা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দশটি গাড়ি যাচ্ছে সঙ্গে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, দেশান্তর, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যা, ষড়যন্ত্রের মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। এর মধ্যে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা-ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান তিনি। আরও কয়েকটি অপরাধে আদালত যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডাদেশ দিলেও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হওয়ায় সেসব সাজা ভোগের প্রয়োজন পড়েনি।শনিবার রাতেই কামারুজ্জামানের মরদেহ তার পরিবার পরিজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদীপাড়া গ্রামের বাড়িতে তার নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হবে। কারাগারের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তায় সেখানে পাঠানো হবে মরদেহ। শনিবার রাত ১০টার কিছু সময় আগে কারা অভ্যন্তরের নিয়ম অনুযায়ী কামারুজ্জামানের প্রথম স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়, এরপর তাকে তওবা করাতে মৌলভীকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট প্রিজন কেবিনে ঢুকেন। তওবা করানোর পর ফাঁসিকাষ্ঠে নেওয়া হয় তাকে।পৌনে ১০টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সকে কারাফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। সন্ধ্যায় এই জামায়াত নেতার সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা দেখা করে বেরিয়ে আসার পর কারা ফটক এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের পর কর্মকর্তাদের ভেতরে ঢোকার ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছিল, রাতের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
এরপর এক এক করে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারা অভ্যন্তরে ঢুকতে দেখা যায়। রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং ঢাকার সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা কারাগারের ভেতরে ঢোকেন। তার আগে ঢুকতে দেখা যায় র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলমকে।এর আগে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন আহমদ কারাগারে ঢোকার পরপরই নাজিমুদ্দিন রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. ফরমান আলীসহ অন্য কারা কর্মকর্তারাও ছিলেন ভেতরে।বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়ে আছে কারাফটকসহ আশপাশে, সঙ্গে রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরাও। কারাগারের প্রধান ফটকে একটি আর্চ ওয়ে বসানো হয়। কারা এলাকায় এখন ২২ প্লাটুন পুলিশ কাজ করছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এর বাইরে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশও রয়েছে।বিকালে কামারুজ্জামানের পরিবার কারাগারে ঢোকার পরপরই এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকরের ইঙ্গিত দেখে অনেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিল।সন্ধ্যার পর সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে পুলিশ সবাইকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানাতে থাকে। পরে সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বিপুল সংখ্যায় পুলিশের অবস্থানের বিষয়ে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সব ধরনের নাশকতা এড়াতে এই পদক্ষেপ।এর আগে দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রায় কার্যকরকে ঘিরে কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সেজন্য পুলিশের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।নিরাপত্তা জোরদারের আগে বিকালে কারাগারে যান কামারুজ্জামানের স্ত্রী-সন্তানসহ স্বজনরা। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর কারাগার থেকে বেরিয়ে চলে যান তারা। এটাই ছিল তার সঙ্গে স্বজনদের শেষ সাক্ষাৎ।বিকেল চারটার সময় দেখা করতে যান তাঁরা। সোয়া এক ঘণ্টা পর তাঁরা বের হয়ে আসেন।বারবার ফাঁসির আয়োজন করেও পিছিয়ে যাওয়ার সরকারের নাটক বলে দাবি করেন একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল।শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় কারাগারের বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।সাংবাদিকরা কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,রাষ্ট্রপতি প্রাণ ভিক্ষা দেয়ার কে? প্রাণ ভিক্ষা চাইবো আল্লাহর কাছে। ফাঁসি কার্যকর না করে সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কালক্ষেপণ করেছে বলে অভিযোগ করেন। এছাড়া গতকাল শুক্রবার দুই জন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে গেলেও তারা তার বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি এবং এ ব্যাপারে তাকে কিছুই বলা হয়নি বলে জানান হাসান ইকবাল। সরকার মিথ্যা খবর প্রচার করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।বাবাকে কেমন দেখে এসেছেন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বাবাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছি। তার মনোবল দৃঢ় আছে। তিনি সুস্থ আছেন। ফাঁসি তিনি মোটেও বিচলিত নন।কামারুজ্জামানের শেষ ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসান ইকবাল বলেন, তিনি বলেছেন, আমি বাংলাদেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। এখন তরুণ প্রজন্ম এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারাই এ অন্যায়ের জবাব দেবে। বাবা আমাদের সৎ পথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। ৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে প্রস্তত রয়েছেন জল্লাদ রানার নেতৃত্বে ৪ জন। জল্লাদ রানা এর আগে জামায়াতের আরেক শীর্ষ নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় সহকারী জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছেন।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদিকে শনিবার বিকেলেই পরিবারের সদস্যরা শেষ বারের মতো কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেছেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৮ নং কনডেম সেলে কামারুজ্জামানের সঙ্গে তাদের দেখা হয়।।কারা সূত্র জানায়, কামারুজ্জামানের সঙ্গে শেষ দেখা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার স্ত্রী নুরুন্নাহার। তাকে সান্ত্বনা দেন কামারুজ্জামান নিজেই। প্রায় এক ঘণ্টা পরিবারের সদস্যরা সেখানে অবস্থান করে।মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ড পাওয়া জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন স্বজনরা কারাগারে শেষ সাক্ষাৎ করেন। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় সাক্ষাৎ শেষে সাড়ে ৫টা ২০ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরা। বের হয়ে চলে যাওয়ার সময় কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ ভি চিহ্ন দেখান। আবার কারো চোখে পানিও দেখা যায়।
দুটি গাড়িতে করে বিকাল ৪টার দিকে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, ভাই কামরুল ইসলাম, শ্যালক রুম্মান, ছেলে হাসান ইমাম ও হাসান ইকবাল,মেয়ে আতিয়া নূর ও দুই শিশুসহ ২৪ জন সদস্য কারাগারে প্রবেশ করেন। এর আগে কামারুজ্জামানের সঙ্গে তার স্বজনদের বিকাল ৪ টা থেকে ৫ টার মধ্যে কারাগারে দেখা করতে কারা কর্তৃপক্ষ শনিবার দুপুরে শেষ বারের মতো অনুমতি দেয় বলে জানান তার ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামী।কামারুজ্জামানের ফাঁসির দন্ড কার্যকরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ও আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌছাঁছে। রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার করা হয়েছে। কারাগার ও আশপাশের এলাকায় নেয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা।
কামারুজ্জামান তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি তার জন্য দোয়া করতে বলেছেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।শুক্রবার প্রাণভিক্ষার জন্য কামারুজ্জামান কোনো আবেদন করবেন না বলে জানানোর পর তাঁর ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি শুরু হয়। তবে শুক্রবার রাতে সব প্রস্তুতির পরও রায় কার্যকর করা হয়নি। শনিবার ফাঁসি কার্যকরের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। রাতের যেকোনো সময় ফাঁসি কার্যকর হতে পারে এমনটাই বিভিন্ন সূত্রের দাবি। এদিকে, এ রায়কে কেন্দ্রকরে যাতে দেশে কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টি না হয় সেই লক্ষে দেশব্যাপী রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে বলে একাধিক পুলিশ সুপার (এসপি) নিশ্চিত করেছেন।এছাড়া এই ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে নাশকতারোধে সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোতে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।এইকভাবে রাজধানী ঢাকা রয়েছে কড়া নিরাপত্তায়। মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কড়া নিরাপত্তায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কোথাও যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেই জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে সদা তৎপর।নিরাপত্তার কথা জানিয়ে এলিট ফোর্স বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দেশবাসীর নিরাপত্তার জন্য র্যাব সদা প্রস্তুত থাকে।
কিন্তু বিশেষ করে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের নাশকতা দমনে র্যাব প্রস্তত রয়েছে। এই বিষয়ে সারা দেশে র্যাবের প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়্যানকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা মোতাবেক সবগুলো ব্যাটালিয়্যান দায়িত্ব পালন করছে।মুফতি মাহমুদ খান আরও বলেন, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর যেন কোনভাবেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সেই দিকে আমাদের সর্বোচ্চ দৃষ্টি আছে।তিনি বলেন, এই সময়ে যে বা যারা আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটানো চেষ্টা করবে তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। পাশাপাশি তাদের ধরে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনায় কামারুজ্জামানের করা আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় শুক্রবার তার দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি দেখা গেলেও পরে তা হয়নি।
শুক্রবার রাতে একটি রিকশা ভ্যানে করে অন্তত আটটি বাঁশ, বড় আকারের তিনটি কার্টন এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ত্রিপল কারাগারে ঢোকাতে দেখা যায়। ফাঁসির মঞ্চের জন্য এসব প্রয়োজন বলে কারা কর্মকর্তারা জানান।মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনায় (রিভিউ) কামারুজ্জামানের আবেদন সোমবার সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হওয়ার পর তার কাছে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগই ছিল। বৃহস্পতিবার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার পর কামারুজ্জামান সময় নিয়ে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর শুক্রবার তার সিদ্ধান্ত জানতে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট যান কারাগারে। শনিবার বিকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কামারুজ্জামান। এর আগেই স্বজনদের দেখা করতে ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার দ্বিতীয় ফাঁসির রায় কার্যকর, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হলো একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব কমান্ড দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর।এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল জামায়াতেরই অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। মিরপুরের কসাই’ আলবদর কমান্ডার কাদের মোল্লাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল রাত দশটা এক মিনিটেই।বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল জুড়ে নারকীয় সব যুদ্ধাপরাধের হোতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির লিভারে টান দিয়ে ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করেন প্রধান জল্লাদ রানা। অন্য তিনজন জল্লাদ ছিলেন তার সহযোগী। জল্লাদ রানা এর আগে আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় সহকারী জল্লাদের ভূমিকা পালন করেছেন।এর আগে দুপুরে কারাগারে পৌঁছায় মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ও সশস্ত্র বিরোধিতাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে সরকারের নির্বাহী আদেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সে আদেশও তাকে পড়ে শোনানো হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।দুপুরেই কামারুজ্জামানের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে শেষবারের মতো তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকে পাঠায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। বিকেল চারটার পরপরই ২১ জন স্বজন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শেষ সাক্ষাৎ করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুর জেলার সোহাগপুর গ্রামে ১৬৪ জনকে হত্যা ও নারী নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২।এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলে গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।গত ১৮ ফেব্র“য়ারি আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে গত ৫ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৬ এপ্রিল এ আবেদনও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। গত বুধবার (৮ এপ্রিল) রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পাঠানো হয় কারাগারে।এরপর তার মৃত্যুদণ্ড রোধে একটাই পথ ছিলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। ফাঁসির রায় পড়ে শোনানোর পর তাই তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না। তখন থেকে সিদ্ধান্ত নিতে যৌক্তিক সময় চেয়ে চারদিন কাটিয়ে দেন এই জামায়াত নেতা। পরে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) তার কাছে আবারও শেষ সিদ্ধান্ত জানতে চাওয়া হয়। এ সময়ই সিদ্ধান্ত জানতে যাওয়া দু’জন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়, কামারুজ্জামান ক্ষমা চাইছেন না। প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় কারাগার।এভাবেই আইনগত সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই কার্যকর হলো তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ।
ফাঁসি দেওয়ার আগে ৮নং কনডেম সেলে গিয়ে কামারুজ্জামানকে গোসল করিয়ে কারাগারের মাওলানার মাধ্যমে তওবা পড়িয়ে নেন কারা কর্তৃপক্ষ। এ সময় তার কাছ থেকে তার শেষ কোনো কথা থাকলে তাও শুনে নেন কারা কর্মকর্তারা।ধর্মীয় রীতি অনুসারে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন। এর আগেই তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব।সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী রাতেই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, এটাই আপনার শেষ রাত। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে।মাওলানা মনির হোসেন তাকে বলেন, আপনার কৃতকর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন।এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন। তারা কামারুজ্জামানকে নিয়ে যান ফাঁসির মঞ্চে। আগে থেকেই মঞ্চের পাশে রাখা ছিল মরদেহ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স।ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার পর তার মাথায় পরানো হয় একটি কালো রংয়ের টুপি। এই টুপিটিকে বলা হয় যমটুপি।
ফাঁসির মঞ্চে তোলার পর কামারুজ্জামানের দুই হাত পিছন দিকে বাধা হয়। এ সময় ফাঁসির মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন কারা কর্তৃপক্ষ, সিভিল সার্জন ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসির মঞ্চে প্রস্তুত ছিলেন জল্লাদও। মঞ্চে তোলার পর তার দুই পাও বাধা হয়। পরানো হয় ফাঁসির দড়ি।কারা কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল একটি রুমাল। রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেন। লিভারটি টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসির মঞ্চের নিচে চলে যান কামারুজ্জামান। এ সময় তিনি মাটি থেকে ৪-৫ ফুট শূন্যে ঝুলে থাকেন। এতে মুহূর্তের মধ্যেই তার ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়।ফাঁসি কার্যকর করার সময় ফাঁসির মঞ্চে ও কারাগারের ভেতরে ছিলেন আইজি (প্রিজন) সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল কবির, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ফরমান আলী, জেলার নেসার আলমসহ অন্য কারা কর্মকর্তারা।
ছিলেন ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, কারাগারের চিকিৎসক আহসান হাবিব, ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ডিএমপি কমিশনারের প্রতিনিধি ডিসি-ডিবি (নর্থ) শেখ নাজমুল আলম।কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সন্ধ্যায় জেলখানার মূল ফটক ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়।পুরো কারাফটক জুড়ে ছিলেন ২২ প্লাটুনের মতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। পুলিশের পাশাপাশি ছিলেন র্যাব এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় কারাগারের সামনের সড়কে সাধারণ যান চলাচলও।কামারুজ্জামানের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার আইনজীবীরা ৮ এপ্রিল সাক্ষাত করেন। প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে কি-না, এ প্রশ্নের জবাবে কামারুজ্জামানের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনির সাক্ষাত শেষে ওইদিন সাংবাদিকদের বলেন,তিনি আমাদের কাছে আইনের প্রভিশনগুলো জানতে চেয়েছেন, দেশে কী নজির রয়েছে তা জানতে চেয়েছেন। আমরা তাকে সাধ্যমতো জানিয়েছি। বাকি বিষয়গুলো নিতান্তই তার সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে ভেবে-চিন্তে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে আমাদের জানান।
কামরুজ্জামানের প্রাণভিক্ষার বিষয় জানতে কেন্দ্রীয় কারাগারে শুক্রবার দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে গিয়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্র্যাট তানভীর মোহাম্মদ আজিম ও মাহবুব জামিল কারাগারে যান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার ও সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী। কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাননি।কামারুজ্জামানের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুর্নবিবেচনা) আবেদন খারিজ করে ৬ এপ্রিল রায় দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ।
গত ৮ এপ্রিল ওই রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বেঞ্চের তিন বিচারপতি। তিন বিচারপতি হলেন-বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। রিভিউ খারিজ করে দেয়া রায়ের কপি ওইদিনই ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করে সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা। পরে ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্টার আফতাব-উজ-জামান রায়ের কপি কেন্দ্রিয় কারাগার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় ওইদিন বিকেলে পৌছেঁ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ রায়ের কপি পাওয়ার পরপরই তা আসামি কামারুজ্জামানকে পড়ে শুনায় বলে কারা সূত্র জানায়।
গত ৫ মার্চ কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করা হয়েছিল। গত বছরের ৩ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ কামারুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেয়। গত ১৮ ফেব্র“য়ারি ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনের সূযোগ থাকায় সে অনুযায়ি তারা আবেদন দাখিল করেছিল।একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। সে থেকে তিনি কারাগারেই ছিলেন।
প্রসঙ্গত, একাত্তরে খুনের উৎসব চালিয়ে সেই রক্তে স্নান করেছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সামরিক শাসনামলে রাজনীতির অধিকার ফিরে পেয়ে হয়েছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখপত্রের সম্পাদক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে।শনিবার ফাঁসিতে ঝোলা কামারুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন উচ্চ মাধ্যমিকের এই ছাত্র।এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে উঠে এসেছে।ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাহিনী গঠন করে কামারুজ্জামান যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বাহিনীর পাশবিকতার চেয়েও ভয়াবহ বলে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে।আদালত বলেছে, একমাত্র জানোয়ার ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে অভিযুক্তের কর্মকাণ্ডের তুলনা চলে না।দীর্ঘ পাঁচ বছর বিচার চলাকালে নিজের কৃতকর্মের জন্য আদালতের কাছে কোনো রকমের অনুশোচনা দেখাননি কামারুজ্জামান, যা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদেরও হতবাক করেছে।
যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের সবচেয়ে বড় কুকীর্তি সোহাগপুরের গণহত্যা। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে কামারুজ্জামান ও তার বদর সহযোগীরা।আপিল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার লেখা রায়ে বলা হয়, হত্যা ও ধর্ষণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কামারুজ্জামান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই ঘটনা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বর। অপরাধ সংগঠনকারীরা কেবল পুরুষদেরকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের হাত থেকে বিধবারাও নিস্তার পাননি।এমনকি যে নারীরা অপরাধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পালিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন পর ফিরে এসেছিলেন, তারাও রেহাই পাননি।এই সব বর্বর ঘটনায় কামারুজ্জমান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। নাৎসিরাও এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করে নাই।
জামালপুরে আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই, শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায়।জামায়াতে ইসলামীর তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন তিনি।এরইমধ্যে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের অনুকূল্যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফেরে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়ত। আর ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে কর্মকাণ্ড শুরু করে। ১৯৭৮ থেকে এক বছর শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামে যোগ দেন। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।১৯৮২-১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন কামারুজ্জামান।পরে জামায়াতের সাপ্তাহিক পত্রিকা সোনার বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন।১৯৯২ সালে তাকে দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় কামারুজ্জামানকে।কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। জামায়াত সংশ্লিষ্ট পত্রিকা নয়া দিগন্ত এবং স্বামীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সোনার বাংলাতেও তিনি লিখতেন।
এই দম্পতির পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার বড় হাসান ইকবাল ওয়ামি এক সময় দিগন্ত টিভির গবেষণা সেলে কাজ করতেন। মিথ্যা তথ্য প্রচারের কারণে টেলিভিশনটি বন্ধ হয়ে গেলে একটি স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি।দ্বিতীয় ছেলে হাসান ইকরাম ওয়ালি সুইডেনে মালমো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছেন।এ দুই ভাই এক সময় ব্লগে লিখতেন, তবে সেসব লেখা এখন আর দেখা যায় না। কামারুজ্জামানের তৃতীয় ছেলে হাসান জামান কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করছেন মালয়েশিয়ার একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে। চতুর্থ ছেলে হাসান ইমাম জামায়াত নেতাদের অর্থপুষ্ট ইবনে সিনা ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত।পঞ্চম ছেলে আহমেদ হাসান কৃষিবিদ গ্র“পের মার্কেটিং বিভাগে কাজ করছেন। আর একমাত্র মেয়ে আতিয়া নূর পড়ছেন মিরপুরের মণিপুর স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হলে ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। আর একই বছর ২ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এই জামায়াত নেতাকে।কামারুজ্জামান যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের আল বদর বাহিনীর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তার পক্ষে দৈনিক সংগ্রামে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনও প্রমাণ হিসেবে আদালতে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ।দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করলেও ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি বহাল থাকে।আদালতের রায়ে বলা হয়, আলবদর বাহিনী গঠন এবং পরে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবাদের ধর্ষণে কামারুজ্জামানের কার্যক্রম ছিল অমানবিক ও বিভীষিকাময়। এই অপরাধ সংগঠনে আমরা একজন মানুষ ও একটি জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।কামারুজ্জামান তার সাঙ্গপাঙ্গরা একজন একজন করে সেই গ্রামের মানুষদের হত্যা করে। ছয় ঘণ্টা ধরে এই খুনের উৎসব চালিয়ে এরপর তারা রক্তে স্নান করে।এমনভাবে তারা খুনের উৎসব চালাচিছল, যেন তারা পাখি বা প্রাণী শিকার করছে।মানবতা বিরোধী অপরাধে এর আগে মৃত্যুদণ্ড জামায়াতের আরেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, সোহাগপুর গ্রামের হত্যা ও ধর্ষণ আব্দুল কাদের মোল্লার হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও ভয়াবহ। এ কারণে এটাই সবচেয়ে যথাযথ মামলা, যেখানে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র শাস্তি।আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ করে দিলে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে শনিবার তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলো।