দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৯ এপ্রিল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ৭০ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছে। সব বাড়িতে বিদ্যুতের আলো জ্বলতে আর বেশি সময় নেবে না।প্রধানমন্ত্রী স্বল্প সময়ের মধ্যে বিরক্তির বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে দেশকে স্বস্তি দিতে ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে নিরলস পরিশ্রমের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু যখন দেশের মানুষ এমনকি রাজধানীর নাগরিকরা তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছিলেন, সে সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন কাজ ছিল।তিনি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে একথা বলেন।
২০০৯ সালের প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি সঞ্চালন লাইন উপযোগী করা ও গ্যাস সমস্যা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছি। এর ফলে বর্তমানে ৭০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে এবং অবশিষ্ট মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছতে খুব বেশি সময় প্রয়োজন হবে না।প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় ও তাদের কর্মতৎপরতা জোরদার করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়গুলো পরিদর্শনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ তিনি দ্বিতীয়বারের মতো এ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে আসেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী বীর বিক্রম, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সংশ্লিষ্ট সচিবগণ, মন্ত্রণালয় ওপ্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।পরিদর্শনকালে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রণালয়টির ইতোমধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কর্মতৎপরতায় এখাতে বাংলাদেশ এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, যা অনেক দেশকে বিস্মিত করেছে।তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন ১৩ হাজার ২৬৫ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, ২০০৯ সালে যা ছিল ৩ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ১৬শ’ মেগাওয়াট এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরে তা বেড়ে ৪ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়।এরপর বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে তা ৩ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে মানুষের জীবনের ৭টি বছর অতিবাহিত হয়। এ সময়ের মধ্যে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি।শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে আরো ১২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া রামপালে কয়লাভিত্তিক ও মহেশখালির মাতার বাড়িতে এলএনজি ভিত্তিক বড় আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে।তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হচ্ছে উন্নয়নের প্রধানতম উপকরণ এবং মানুষের প্রতিটি কাজ এখন জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মানুষের চাহিদাও পরিবর্তন এসেছে। আগে ছিল কেবল ভাত ও ঘরের চাহিদা। এখন মানুষ চায় বিদ্যুৎ।শেখ হাসিনা বলেন,তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা। কারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও দেশের কাক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাঁর সরকার প্রথম বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, গ্যাস মজুত অনুসন্ধানে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা, গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক বিডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে আইন প্রণয়ন করে।আওয়ামী লীগের কার্যকালে বেসরকারি খাতে প্রথম হরিপুরে ৩৬০ মেগাওয়াট ও মেঘনাঘাটে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয় একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার শিল্প মালিকদের চাহিদা মেটাতে তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং নিজস্ব চাহিদা পূরণের পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডের মাধ্যমে অন্যের কাছে বিক্রির অনুমতি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোলার বিদ্যুতের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, চর, পার্বত্য এলাকা এবং দ্বীপ সোলার জ্বালানি দিয়ে আলোকিত করতে হবে। এ সকল এলাকা নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোলার বিদ্যুৎ আমাদের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ এবং এটি খুবই সহজলব্য। এর প্রাথমিক খরচ খুবই সামান্য। অথচ গ্রাহকদের জন্য খুবই উপযোগী।শেখ হাসিনা বলেন, দেশে ২১টি অর্থনৈতিক জোনের সব কটি তাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট দিয়ে চলবে। এ সকল প্ল্যান্ট স্থাপনে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদেরকে জমি দেয়া হবে। প্রত্যেক জোনে জলাশয় থাকবে এবং এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন, সুবিধা প্রদানে গ্রীড লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। নিকটবর্তী গ্যাস ক্ষেত্র থেকে এ সকল পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাস সরবরাহ করা হবে।শেখ হাসিনা বলেন, পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনে কৃষি জমি ও শিল্প জমি ব্যবহার করা হবে না। সোলার প্যানেল স্কুল ভবনের এবং অফিস ভবনের ছাদের উপর স্থাপন করা যেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দিনের বেলায় এ সকল সোলার প্যানেল কার্যকর থাকে।
প্রধানমন্ত্রী পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের অগ্রগতির উল্লেখ করে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এটি হবে বিদ্যুৎ সেক্টরে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত।শেখ হাসিনা বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ৫শ’ মেগাওয়াট এবং আগরতলা থেকে ১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হবে। তিনি বলেন, এছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যয়ের চেয়ে স্বল্প খরচে এ সকল দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা যাবে।প্রধানন্ত্রী আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যথাযথভাবে পরিচালনা এবং পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থলে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে স্থাপনে আহ্বান জানান। এতে গ্যাস ও জ্বালানি খরচও কম হবে।শেখ হাসিনা গ্যাসের রিজার্ভের ওপর জরিপ চালানো এবং নতুন নতুন গ্যাস কুপ খননে পদক্ষেপ গ্রহণের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা এ সকল গ্যাস কুপ থেকে তেল পাব। এ সকল প্রকাৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানে পদক্ষেপ নিতে হবে।প্রধানমন্ত্রী নতুন জলসীমায় গ্যাস ব্লকের সীমানা নির্ধারণ এবং গ্যাস অনুসন্ধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার উপরও গুরুত্বারোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ি হতে জনগণকে সচতেন করে গড়ে তুলতে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিদ্যুতের ব্যবহার হ্রাস এবং গ্রাহকদের বিল কমাতে হবে। তিনি বলেন, পরিবার এবং স্কুল পর্যায়ে প্রত্যেক ছেলে- মেয়েকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ি হতে শেখাতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি পাকা ভবন নির্মাণের সময়ে ঘরে আলো প্রবেশ করতে পারে এজন্য প্রয়োজনীয় ভ্যান্টিলেটার রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমরা প্রাকৃতিক আলো বাতাসে বেঁচে থাকতে চাই।শেখ হাসিনা পল্লী এলাকায় অধিক বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, পল্লী অঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে বিদ্যুতের গুরুত্ব অপরিসীম। পল্লী এলাকায় অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ দেয়া মানে দেশে অধিক পরিমাণ উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া।প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা। এজন্য দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করতে হবে।শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের উন্নয়নের দৃশ্যমান দিক হলো পল্লীর জনগণের উন্নয়ন। মধ্যম ও নি¤œ আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো এবং আয় বৈষম্য কমানো। তিনি বলেন, আমরা সমাজে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন এনেছি। তবে এক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো অনেক দূর যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সারাদেশে বিশেষ করে পল্লী এলাকায় শিল্প স্থাপন করতে হবে।শেখ হাসিনা দেশে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক দলের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের উল্লেখ করে বলেন, এ সকল রাজনৈতিক দল বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যেখানে কাজ করে যাচ্ছি, সেখানে এ সকল রাজনৈতিক দল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগুন দিচ্ছে। এটি সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা। দেশটি তো আমাদের। আমরা দেশকে ভালবাসি। কোন রজানৈতিক নেতার দেশের প্রতি সামান্য ভালবাসা থাকলে তারা কখনো এ ধরনের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করতে পারে না।প্রধানমন্ত্রী দেশ এই অবস্থা মোকাবেলা করে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে দেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে বলে আশা ব্যক্ত করেন।