কামারুজ্জা্মান1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৬ এপ্রিল: মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায়ের কপি এখনো কারাকর্তৃপক্ষের হাতে এসে পৌঁছেনি। তবে রায়ের কপি না পৌঁছালেও ফাঁসির সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি আজ রাতে কার্যকর হচ্ছে না। সোমবার রাতে নিশ্চিত করেছেতিনি বলেন, রায়ের কপি হাতে না পাওয়ায় কারণে পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া আজকে সম্ভব হচ্ছে না।এর আগে এ বিষয়ে জেলসুপার ফরমান আলী সোমবার বিকেলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, অফিস চলাকালীন অর্থাৎ বিকেল পর্যন্ত কামারুজ্জামানের রায়ের কপি হাতে পায়নি জেল কর্তৃপক্ষ।রায়ের কপি হাতে না পেয়ে থাকলে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কেন ডাকা হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু আদালত রায় দিয়েছেন,সে কারণে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়েছে।রায়ের কপি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জেলসুপার বলেন, আদালত যেহেতু রায়ের কপি পাঠিয়েছেন সেহেতু যে কোনো সময় তা কারাগারে আসতে পারে।

অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার আমিনুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল এও জানায়, মঙ্গলবার রায়ের কপিতে সই করবেন বিচারপতিরা। আর রায় প্রদানকারী বিচারপতিরা স্বাক্ষর দেওয়ার পর রায়ের অনুলিপিটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হবে।এরপরেই এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে কারা কর্তৃপক্ষ।

রাতে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর কারাকর্তৃপক্ষের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরপরই কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হবে। সেই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। যদি তিনি প্রাণভিক্ষা চান তাহলে সে অনুযায়ী তাকে সুযোগ দেয়া হবে। আর যদি না চান তাহলে আইনানুযায়ী পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।প্রাণভিক্ষা না চাইলে আজ রাতে তাকে ফাঁসি দেয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কারাগারের ভেতর চলে যান। এদিকে, যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে পৌঁছেন। বিকেল সাড়ে ছয়টার সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে পৌঁছান তারা।

একটি মাইক্রোবাসে (নং: ঢাকা মেট্রো-চ-২৫৮৬) করে কারাগারে পৌঁছান পরিবারের সদস্যরা। এদের মধ্যে ৫ জন বয়ষ্ক ও ৪টি শিশু। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, দুই ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি ও হাসান ইমাম ওয়াফি, মেয়ে আতিয়া নূর ও ভাগ্নি রোকসানা জেবিন। আগে থেকেই কারা ফটকে ছিলেন জামায়াতের একাধিক নেতা। সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে তারাসহ মোট ১৪ জন কামারুজ্জামানের দেখা করতে কারাগারের ভেতরে ঢোকেন। এছাড়া কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন জামায়াতের পাঁচ নেতাও।সন্ধ্যা পৌনে সাত টার দিকে এই ১৪জন কারা ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকেন এবং ঘণ্টা খানেক সেখানে থেকে রাত পৌনে আট টায় বের হয়ে আসেন।এসময় অপেক্ষারত সংবাদকর্মীরা কথা বলার চেষ্টা করলে কোনও কথা না বলেই চলে যান তারা।এর আগে, কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডাকা হয়েছে বলে জানায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকালে কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখার পর এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেই জানান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।কামারুজ্জামানের পরিবারও জানায় বেলা ৩টার কিছু আগে তাদের কাছে কারা কর্তৃপক্ষের চিঠি পৌঁছায়। চিঠিতে বিকেল ৫টার মধ্যে দেখা করার নির্দেশনা ছিলো। একটি মোটরবাইকে চেপে তিনজন কামারুজ্জামানের মিরপুরের বাড়িতে কারা কর্তৃপক্ষের চিঠিটি নিয়ে যায় বলে জানান পরিবারের একজন সদস্য। এদিকে, একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিলের রায়ের (পুনর্বিবেচনার) কপি আদালত থেকে এখনো হাতে পাননি সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার। সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলাম রায়ের কপি না পাওয়া বিষয়টির নিশ্চিত করেন।তিনি বলেন, কামারুজ্জামানের রিভিউ পিটিশনের আদেশের কপি আমরা এখন পর্যন্ত হাতে পাইনি। আদেশের কপি হাতে পাওয়ার পর পরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।নিয়মানুয়ায়ী রায়ের কপি রেজিস্ট্রার হাতে পাওয়ার পর এটিতে তিনি স্বাক্ষর করবেন। তারপর এটি পাঠানো হবে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর শুরু হবে ফাঁসি কার্যকরের কার্যক্রম।রিভিউ খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশ হাতে না পাওয়ায় ফাঁসির আসামি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে তা জানাতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। এই যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা চাইবেন কি-না সে প্রশ্নের সুরাহা না হওয়ায় আটকে আছে তার দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া।দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সোমবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্ডার না গেলে আমি কী করে বলবো? আদেশটাতো যাইতে হবে। আদেশটা না গেলে ক্যামনে ফাঁসি দেয়।তবে কারা কর্তৃপক্ষ সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলেও জানান মন্ত্রী।এর আগে সকালে রায় হওয়ার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা আগেই জারি হওয়ায় দণ্ড কার্যকরে নতুন করে আর কোনো আনুষ্ঠানিক আদেশের প্রয়োজন হবে না।এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী বলেন, নিশ্চয়ই যেতে হবে। নিশ্চয়ই যেতে হবে। আদেশটা যেতেই হবে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী সোমবার সন্ধ্যায় জানান, আদালত থেকে কোনো সংক্ষিপ্ত আদেশ তাদের হাতে পৌঁছেনি।কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না- তাও তাকে জানাতে পারিনি।নিয়ম অনুযায়ী কামারুজ্জামান অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইলে রাষ্ট্রপতি তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন। ওই আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে অথবা কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন।২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রেও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল। তবে সে সময় কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

আইনমন্ত্রী দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে কামারুজ্জামানকে কয়েক ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে। যতো দ্রুত সম্ভবএই রায় কার্যকর করা হবে। কাদের মোল্লার রিভউ পিটিশনের যে রায় বেরিয়েছিল সে রায়ে আপিল বিভাগ পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এসব ক্ষেত্রে জেল কোড এপ্লিকেবল হবে না। সেক্ষেত্রে জেল কোডের যে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে- ক্ষমা প্রার্থণা করতে সাত দিন সময় পাবেন- সেসব বিষয় এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।তবে আদালতের রায় হাতে পেলে তবেই প্রাণভিক্ষার বিষয়টি কামারুজ্জামানকে জানানো যাবে বলে কারা তত্ত্বাবধায়ক জানান। কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী শিশির মনিরও বলছেন, আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি কারাগারে না পৌঁছানো পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা যাবে না বলেই তারা মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের নিবন্ধক সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বিকাল ৫টার দিকেও জানিয়েছেন, সংক্ষিপ্ত রায় তখনো আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৌঁছেনি। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সোমবার সকালে খারিজ করে দেয় প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ।

এরপর আইনজীবীরা প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলেও কারা কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দেয়। ফরমান আলী বলেন, এই পর্যায়ে এসে আইনজীবীদের সাক্ষাৎ করতে দেওয়ার সুযোগ নেই।তবে কারাকর্তৃপক্ষ দুপুরে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠিয়ে কামারুজ্জামানের পরিবারকে দণ্ড কার্যকরের আগে সাক্ষাতের সুযোগ থাকার বিষয়টি জানায়। সে অনুযায়ী সন্ধ্যায় কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন।গত ১৮ ফেব্র“য়ারি আপিল বিভাগ এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় পড্রকাশের পর থেকেই জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলকে এ কারাগারে রাখা হয়েছে।এদিকে সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরপরই পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যায় কারাগারের সামনে রাস্তায় যান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।এর ফলে একাত্তরের হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দণ্ড কার্যকরের বাধা কাটল।প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করেন। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে এজলাসে এসে প্রধান বিচারপতি বলেন, ডিসমিসড। এর আগে রোববার কামারুজ্জামানের আবেদনের ওপর প্রায় দুই ঘণ্টা শুনানি হয়। কামারুজ্জামানের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগ আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডই বহাল থাকল।তিনি জানান, কামারুজ্জামান নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে পারবেন। এ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলে সরকার দণ্ড কার্যকর করবে। যুদ্ধাপরাধী এই জামায়াত নেতা সেই সুযোগ নেবেন কি-না, তা স্পষ্ট করেননি তার আইনজীবীরা। কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী শিশির মনির রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আজই উনার সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগ নেব। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করব। তার সঙ্গে পরামর্শ করে দিক নির্দেশনা নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।

গতবছর ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের এই বেঞ্চই কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে একাত্তরে ময়মনসিংহের আল বদর নেতা কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রায় পুনর্বিবেচনার জন্য শুনানিতে চারটি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো ধোপে টেকেনি।অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল এর বিরোধিতায় বলেছিলেন,আজ যদি আমরা এই যুদ্ধাপরাধীদের অনুকম্পা দেখাই, তাহলে আমরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকব।জামায়াতে ইসলামীর আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায় বলে আদালতের রায়ে উঠে এসেছে।২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে হত্যার ঘটনায় কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুরে ১২০ জনকে হত্যার ঘটনায় আপিল বিভাগের চার বিচারকও সর্বসম্মতভাবে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।তবে চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ।এছাড়া ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন ও ১০ বছর কারাদণ্ডের দুটি অভিযোগ বহাল রেখে যাবজ্জীবনের একটি অভিযোগ থেকে সর্বোচ্চ আদালত কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়।গত ১৮ ফেব্র“য়ারি আপিল বিভাগের ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে।

রিভিউ খারিজ হওয়ায় কামারুজ্জামান নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পেলেও যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে কারাবিধির সাত দিনের বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য হবে না বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এল।এর আগে আপিল বিভাগে আসা যুদ্ধাপরাধের প্রথম মামলায় জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।

স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। একসময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদে থাকলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে তাকে বহিষ্কার করা হয়।১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীকে সংগঠিত করেন বলে যে তথ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন উপস্থাপন করেছে- আসামির আইনজীবীরা তা খণ্ডাতে পারেননি। প্রসিকিউশন অভিযোগে বলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে বৃহত্তর ময়মনসিংহে যে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়, কামারুজ্জামান ছিলেন তার ‘চিফ অর্গানাইজার।এর পক্ষে প্রসিকিউটররা দৈনিক সংগ্রামের সেই সময়ের একটি প্রতিবেদনও উপস্থাপন করেন, যে পত্রিকাটি জামায়াতরে মুখপত্র হিসাবে পরিচিত।

আর দল হিসাবে জামায়াতকেও যুদ্ধাপরাধে দায়ী করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সেই সময়ে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের সন্ত্রাসী ও গুপ্তচর’ আখ্যায়িত করে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করে নিজেদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর এবং জামায়াতকর্মীদের নিয়ে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে। দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনায় মূল ভূমিকা রাখে। আর আল বদর বাহিনী কাজ করে খুনে বাহিনী ( ডেথ স্কোয়াড) হিসাবে।

গত ৫ মার্চ কামারুজ্জামানের পক্ষে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করা হয়। এর আগে গত ১৮ ফেব্র“য়ারি ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। গত বছরের ৩ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ কামারুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেয়।ট্রাইব্যুনাল তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে আসামি কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আপিলের রায়ে বলা হয়, তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। তবে চতুর্থ অভিযোগ গোলাম মোস্তফাকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে দেয়া সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ। দ্বিতীয় ও সপ্তম অভিযোগে কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া দন্ড সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়েও বহাল রাখা হয়। দ্বিতীয় অভিযোগে অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়। আর সপ্তম অভিযোগে গোলাপজান গ্রামের পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় তাকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ট্রাইব্যুনালে দেয়া এ দুটি সাজাই বহাল রাখে আজ আপিল বিভাগ।প্রথম অভিযোগ শেরপুরের কালীনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে হত্যার ঘটনায় কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও আপিল বিভাগ আজ তাকে খালাস দিয়েছে। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে জানানো হয়েছিল। এ দুটি অভিযোগের বিষয়ে প্রসিকিউশন তথা রাষ্ট্রপক্ষের আপিল না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।চূড়ান্ত রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনের সূযোগ থাকায় সে অনুযায়ি তারা আবেদন দাখিল করে।রায় প্রকাশের পর কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা গত ১৯ ফেব্র“য়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে।লাল কাপড়ে মোড়ানো এ পরোয়ানার সঙ্গে কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও প্রেরণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রিভিউ দায়ের করায় মৃত্যুদন্ড কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায় বলে এটর্নি জেনারেল জানান।একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলায় ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন ও আসামীপক্ষে মোট ২৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়।২০১২ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এবং গত বছর ৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত আসামিপক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান, জব্দ তালিকার সাক্ষী বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের তথ্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা আমেনা খাতুনসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে ১৮ জন সাক্ষী তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য সাক্ষীরা হলেন- ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি হামিদুল হক, শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আল-বদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন, মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মো. হাসানুজ্জামান, লিয়াকত আলী, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পুত্র জিয়াউল ইসলাম, এডভোকেট আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান মো. জালাল উদ্দিন, মুজিবুর রহমান খান পান্নু এবং দবির হোসেন ভূঁইয়া।এ ছাড়া ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দেন শেরপুরের নলিতাবাড়ি উপজেলার ‘বিধবাপল্লী খ্যাতসোহাগপুর গ্রামের তিন নির্যাতিত নারী।আসামিপক্ষ এসব সাক্ষিদের জেরা করেছিল।কামারুজ্জামানের পক্ষে মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরা হলেন- মো. আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম। প্রসিকিউশন তাদের জেরা করেছেন।ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত ৭টি অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল। একাত্তরে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে আসামিপক্ষ। গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ফাঁসির ওই আদেশ বহাল রাখেন। এরপর গত ১৮ ফেব্র“য়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে কারাগারে পাঠালে সেখানে বন্দী কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। পরে ৫ মার্চ ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে আসামিপক্ষ। সোমবার সেই আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ।