দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৫ এপ্রিল: চলমান রাজনৈতিক সংকটে দেশের ১১টি খাতে উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৯০০কোটি টাকা। যা জিডিপি হিসেবে এ ক্ষতির পরিমাণ শুন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ(সিপিডি)। রোববার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ২০১৫-১৬ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সিপিডির প্রস্তাবনা জানাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানানো হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তৌফিকুল ইসলাম খান।
বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৫-২০১৬’ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, অবরোধের ৮১ দিন এবং হরতালের ৬৭ দিনে মোট ১১টি খাত এই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে এটা সর্বনিম্ন। সব খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে হিসেবে করলে পরিমাণ আরো বাড়বে।খাতগুলো হল কৃষি, পোল্ট্রি, চিংড়ি, গার্মেন্টস, প্লাস্টিক, পরিবহন, ট্যুরিজম, ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসা খাতের হিসেব করা হয়েছে। তবে আবাসন ও শিক্ষা খাতে ক্ষতির নিরুপণযোগ্য নয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।সিপিডির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, এ অবস্থায় সরকারকে বাজেট প্রণয়নে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি-সংস্কার করতে হবে। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতেও দেশের অর্থনীতির ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সূচক ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। যা টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও দেশের অর্থনৈতিক স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে বলে দাবি করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।গত ৫ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৮১ দিনের টানা অবরোধ ও ৬৭টি দিনের হরতালে ১ হাজার ২১১টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১০০ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে কেমন হবে নতুন ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট’ শীর্ষক আলোচনায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন সংস্থার ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।তবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও দেশের বর্তমান সময়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ েেনই বলে জানিয়েছেন তিনি। যা রাজনৈতিক কারণেই হচ্ছে বলে দাবি করেছেন এ অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।গবেষণা প্রতিবেদন দেখা গেছে, ৫ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৮১ দিনের টানা অবরোধ ও ৬৭ দিনের হরতালে দেশের অর্থনীতির মোট ক্ষতি হয়েছে চার হাজার নয়শ কোটি টাকা। যা ২০১৪-১৪ অর্থবছরের মোট জিডিপির প্রবৃদ্ধির শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর ফলে জিডিপির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না। যা ৬ শতাংশের আশেপাশে থাকবে।
দেবপ্রিয় বলেন, সিপিডির যে সমীক্ষা করা হয়েছে, তা থেকে বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বস্তির যে দিকগুলো রয়েছে, তা খুব স্পষ্টভাবে বের হয়ে এসেছে। তার মধ্যে প্রধান ছয়টি স্বস্তির দিক হলো- বাংলাদেশে এ সময়ে মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখি; বাণিজ্যিক সুদের হার নিম্নমুখি; টাকার আন্তর্জাতিক বিনিময় হার স্থিতিশীল; বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; বৈদেশিক আয় বেড়ে উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমার ফলে, বিশেষ করে তেলের দাম কমার ফলে ভর্তুকির উপর যে চাপ ছিল, সে চাপ অনেক কম রয়েছে। এ থেকে বলা যায়- বড় বড় দিক ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে।তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার পরও যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি- বাংলাদেশের এ মুহূর্তে দুইটি সমস্যা রয়েছে। কাঠামোগত সমস্যা ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে তেজি করা যাচ্ছে না।ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ তেজি না হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘উপরন্ত আমদানি বৃদ্ধির কারণে যেসব তথ্য উপাত্ত আসছে, সেগুলোর বিষয়ে আমার সংশয় রয়েছে। যেসব পুঁজিপণ্য আসছে, তা আসলে ভোক্তা পর্যায়ের পণ্য কি না? আর ওইসব পণ্যের শুল্ক যেহেতু কম, সে জন্য মিথ্যাচার বা প্রতারণা আশ্রয় নিচ্ছে কি না? এটি একটি প্রশ্ন।
তিনি জানান, ব্যক্তি বিনিয়োগ না বাড়ার আরো দু’টি বড় কারণ হলো- রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অনুদান রজনীতি। আপকে যদি বাজারভিত্তিক উদার অর্থনীতি গড়ে তুলতে হয়, তার জন্য উদার রাজনীতি অত্যান্ত অত্যবশ্যক থাকতে হবে। তাই রাজনীতিতে যদি অনুদান রাজনীতির পরিবেশ থাকে, তাহলে ব্যক্তি বিনিয়োগের পরিবেশ থাকে না। এটা এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে।আর এ ব্যক্তি বিনিয়োগকে বাড়ানোর পূর্বশর্ত হলো- বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন দুর্নীতি কমিশন, মানবাধিকার কমিশন অথবা প্রশাসনকে দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা। বিনিয়োগের পরিবেশের জন্য এগুলো যদি না থাকে তাহলে আমাদের ব্যক্তি বিনিয়োগকে খুব প্রভাবিত করে।
এ অবস্থায় সরকাররের সক্ষমতার অভাব রয়েছে দাবি করে দেবপ্রিয় বলেন, নিজেদের সক্ষমতা না থাকার কারণে সরকার বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফকে ডেকে নিয়ে আসে। তখন তারা নানান শর্ত চাপিয়ে দেয়, যা আমাদের অভ্যান্তরীণ শক্তি দিয়েই করার কথা ছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থা যা করতে বলে তা খারাপ বলছি না। তবে তা করার দরকার ছিল নিজস্ব শক্তিতে, উদ্যোগে এবং নিজস্ব নির্বাচিত ঘোষিত কর্মসূচির ভিত্তিতে। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার দরকার, তার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় হলো নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সমন্বয়। আর এগুলো না থাকায় যে সক্ষমতার কথা আমরা বলি এবং যে ধারাবাহিকতার অভাব দেখতে পাচ্ছি তাহলো- গত কয়েক বছর যাবৎ বিভিন্ন সময়ে সরকারের ঘোষিত কর্মসূচি যেভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার কথাছিল সেভাবে বাস্তবায়িত হতে পারছে না। এর বহু উধাহরণ দিতে পারবো। যেমন- বাংলাদেশের জিডিপি যে ছয় শতাংশের আশেপাশে আটকে গেছে, এখান থেকে বের হতে হলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সত্যিকার অর্থে বরণ করতে হলে সংস্কার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে। আর তা না হলে এর অভাব অনেক বেশি পীড়াদায়ক হবে বলে মনে হচ্ছে।