8b64a90f45f5ff472b0911be72b31b44-17

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৮ মার্চ: একাত্তরের পরাজিত শক্তি দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।রাজনীতির আবরণে দেশে এখন জঙ্গি তৎপরতা চলছে।এতে দেশ আজ গভীর সংকটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সহিংসতা-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সম্মিলিত নাগরিক সমাজ। শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই জাতীয় সম্মেলন থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। সকালে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন শুরু হয়। এরপর গত ৮২ দিনের অবরোধ-সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।সহিংসতা-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় কনভেনশন থেকে এ আহবান জানানো হয়।সম্মিলিত নাগরিক সমাজ এ কনভেনশনের আয়োজন করে।সম্মেলনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সভাপতি এ কে এম এ হামিদ। সেক্টর কমান্ডার আবু উসমান চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ইব্রাহিম খালেদ,মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সহসভাপতি হেলাল মোর্শেদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবদুর রশীদসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার কয়েক হাজার মানুষ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন পরিচালনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালক নিলুফার বানু।

কনভেনশনে আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী, কর্মজীবী নারীর সভাপতি প্রতিমা পাল মজুমদার, অঙ্গীকার বাংলাদেশের মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী আরমা দত্ত, ডিএসকে’র নির্বাহী দিবালোক সিংহ, স্টেপ টুয়ার্ডস’র প্রধান নির্বাহী রঞ্জন কর্মকার, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব এ এস এম রকিবুল হাসান, পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ট্রাকচালক মো. আরমান প্রমুখ।

সহিংসতাবিরোধী সমবেদনার গান ও জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে কনভেনশনের শুরু হয় সকাল ১০টায়। সমবেদনার গান পরিবেশন করে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার ক্ষুদে শিল্পীরা। এরপর চলমান সহিংসতায় নিহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।কনভেনশনে স্বাগত বক্তব্য দেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের সভাপতি একেএমএ হামিদ। কনভেনশন পরিচালনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালক ড. নিলুফার বানু।

সম্মেলনে সভাপতিত্ব করছেন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক যে নাগরিকেরা, তাঁরা আজ ভয়াবহ সংকটে। ককটেল ও পেট্রল বোমার আগুনে নারী, শিশু নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ দগ্ধ হচ্ছেন। চোরাগোপ্তা হামলা, রেললাইনের ফিশ প্লেট খুলে ফেলা, যানবাহন ভাঙচুর, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। বিঘিœত হচ্ছে পরীক্ষা।খলীকুজ্জামান বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে যে অবরোধ শুরু হয়েছে, ৮৩ দিন ধরে তা চলছে। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, পেশাজীবী, সবাইকে আজ ভয়াবহ কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। ২০১৩ সালেও একই ঘটনা ঘটেছে। এমন সংকটময় মুহূর্তে সম্মিলিত নাগরিক সমাজ গঠন করা হয়েছে। এটি উন্মুক্ত নাগরিক মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা দেশ গড়ার কাজ করব।

দেশের বর্তমান সংকট সমাধানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কঠোরভাবে দমন, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অর্থের উৎস বন্ধ, সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করাসহ

সরকারের উদ্দেশে নয় দফা দাবি তুলে ধরেন খলীকুজ্জামান। রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাজনীতি করা ও পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরুর আহ্বান জানান তিনি।স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচাতে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে দেশে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালাচ্ছে। এজন্য সরকার ও জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতি গড়ে তুলতে হবে।

সরকারকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস বন্ধ করার আহবান জানিয়ে কনভেনশনে বক্তারা বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগুনে পুড়িয়ে বাংলার জনপদকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছিল।সেই আগুন দিয়েই আজ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। সেই আগুন আর এই আগুনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।কনভেনশনে ইব্রাহীম খালেদ বলেন, বাংলাদেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই। তখন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একাত্তরে তারা সফল না হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা পুনর্বাসিত হয়েছে। ফলে এখনো আমরা ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পাইনি।

পঁচাত্তরের পর ভৌগলিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নেই মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হয়েছে। সে সময় ব্যবসা করে তাদের কেউ কেউ কোটিপতি হলেও কোনো মুক্তিযোদ্ধা কোটিপতি হতে পারেননি।

তিনি বলেন,একাত্তরের আগুন আর এখনকার আগুনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতাবিরোধীদের অনুসারীরাই আজকে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে। তারা নব্য রাজাকার। এই নব্য রাজাকারদের চিহ্নিত করে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এখনই তাদের প্রতিরোধ করা না গেলে তারা দেশে আরেকটি গণহত্যা চালাবে। হেলাল উদ্দিন বীরবিক্রম দেশের সবকিছু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সবকিছু মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেনার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকে গেছে। এটা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। এটি করা না গেলে তাদের সমূলে উৎপাটন কখনোই সম্ভব হবে না।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়ে আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই দেশে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানো হচ্ছে। আর এর দিক-নির্দেশনা আসছে লন্ডন থেকে।তিনি বলেন, এসব যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর হলে সন্ত্রাস-সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা ভয় পাবে। তাই আপিল বিভাগে যেসব যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত রায় হয়েছে তা দ্রুত কার্যকর করতে হবে। তা না হলে যেকোনো সময় এরা ছুটে যেতে পারে।

কনভেনশনে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্বরতা দেখেছি, এখনো দেখছি। সন্ত্রাস-সহিংসতা রাজনীতির মূলধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আমাদের জন্য আরো ভয়বাহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধ মতাদর্শের বিপরীতে প্রগতিশীল, উদার ও আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে আরো করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। আর সে জন্যই সমাজের প্রত্যেক শ্রেণী- পেশার মানুষদের নিয়ে আমাদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। একটি আলোকিত আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের নামে দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চলছে। শিক্ষা-অর্থনীতি ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় সচেতন নাগরিক সমাজ নীরব ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাই দেশের শ্রমজীবী- পেশাজীবীদের নিয়ে এ কনভেনশনের আয়োজন করা হয়েছে।এরপর কনভেনশনের অবস্থানপত্র তুলে ধরেন সম্মিলিত নাগরিক সমাজের আহবায়ক ও কনভেনশনের সভাপতি কাজী খলিকুজ্জামান।রাজনীতির আবরণে কোনো সংগঠন জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকলে বা জঙ্গিবাদের মদদদাতা হলে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহবান জানানো হয় অবস্থানপত্রে। সহিংসতার আগুনে নিহতদের পরিবার ও আহতদের সহায়তা-পুনর্বাসনের আহবান জানিয়ে কনভেনশনের অবস্থানপত্রে আরো বলা হয়, সন্ত্রাস-সহিংসতার মদদদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হোক।

কনভেনশন থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও জনকল্যাণের স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আহ্বান জানানো হয় রাজনীতিবিদদের প্রতি। দেশের চলমান সংকটের সমস্যা চিহ্নিত করে অবস্থানপত্রে বলা হয়, ১৯৯৬ এর প্রথম নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন বাদ দিলেও এ পর্যন্ত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরর অধীনে চারটি নির্বাচন হয়েছে। চারটি সরকারই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। অথচ পরাজিত দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংসদে নিয়মিত অংশ না নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক-হিংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে।নির্বাচন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই সংকটের একমাত্র সমাধান নয় বলেও দাবি করা হয় কনভেনশনে।সবশেষে সম্মিলিত নাগরিক সমাজের ৪২ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয় কনভেনশন থেকে। এ কমিটি আরো সম্প্রসারিত হবে বলেও জানানো হয়। দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এর কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় কনভেনশন থেকে।