দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৭ মার্চ: বিশদলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল অব্যাহত থাকলেও তিন সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশহণের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর নির্বাচনমুখী হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি।বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে বদলে যেতে পারে বর্তমান রাজনীতির দৃশ্যপট।কেটে যেতে পারে গুমট আবহাওয়া, ফিরে আসতে পারে স্বস্তি ও শান্তি।এমনকি সিটি নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে বিদেশী কূটনৈতিক মহলেও। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হলেও নির্বাচনী মাঠে বিএনপির অংশগ্রহণের পক্ষে রয়েছেন কূটনীতিকরা। তারা মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের বড় কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক আস্থার অভাব। সিটি নির্বাচনে তারা অংশ নিলে এই আস্থাহীনতা অনেকাংশে কমে আসবে- এমন বার্তা কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে পৌঁছানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আরও জানাগেছে, সিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন কূটনীতিকরা। নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন তারা। এ বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনে ইসির প্রস্তুতির বিষয়ে অবহিত হবেন কূটনীতিকরা।পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা দেয়ার প্রয়োজন আছে কিনা- এমন প্রস্তাবও দেয়া হবে ইসিকে। এই তিন সিটি নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলবে- সে ব্যাপারেও প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন তারা।দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশী কূটনীতিকরা নানা উদ্যোগ নিয়ে গত প্রায় আড়াই মাস ধরে কাজ করছেন।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এবং তাদের শরিকরা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে বদলে যাবে রাজনীতির দৃশ্যপট। দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে চলতে থাকা হরতাল-অবরোধসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে। রাজপথের দমন-পীড়ন-জ্বালাও- পোড়াও-সহিংসতা-নাশকতাসহ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও তাদের চিরচেনা বৈরী রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে তা পরিণত হতে পারে ভোট উৎসবে।
এমন মত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও। তাদের মতে, দুই প্রধান দলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে রাজনীতিতে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের একটি সুযোগ এনে দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিলে টানা হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্তি মিলবে। সাধারণ মানুষসহ সবার দৃষ্টি থাকবে তখন নির্বাচনের দিকে। রাজনীতিও হবে নির্বাচনমুখী। অবসান ঘটবে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার।এ প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনই নির্দলীয়। এসব জায়গায় দলীয়ভাবে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও বাস্তবতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এসব নির্বাচনও দলগত নির্বাচনে পরিণত হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অবস্থায় সবাই মিলে এই নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্যই তা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হবে। রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনবে। জনমনে বিরাজমান উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটবে। মাঠের লড়াই ভোটের রাজনীতিতে পরিণত হবে।সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা- জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নেবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যই আন্দোলন করছে। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দল অংশ নিতে পারে। তিনি আরও বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য বিএনপি যখন আন্দোলন করছে, ঠিক তখন সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতেই সরকার অনেকটা তড়িঘড়ি করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছে। আমি মনে করি সরকার যে কৌশলই গ্রহণ করুক না কেন বিএনপি এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে না। সরকারি দলকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেবে না।
অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। তাদের জনসমর্থন রয়েছে। সরকারের দমন-পীড়নের কারণে বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের মনে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে তারা মাঠে নামলে এ আতংক কেটে যাবে।সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, আসন্ন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ করা উচিত। বিএনপি এই নির্বাচনে এলে আমরা তাদের স্বাগত জানাব।প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু এমপি বলেন, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি যে ভুল করেছে আশা করি তারা আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আর সে ভুল করবে না। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে বিএনপির টানা আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তারা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে নির্বাচন কমিশন ১৮ মার্চ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ২৮ এপ্রিল ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে তিন সিটিতে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২৯ মার্চ। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ১ ও ২ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৯ এপ্রিল। ওই দিনই চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন।সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হচ্ছে- এমন আভাস পেয়েই এতে অংশ নিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আগ্রহী মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রচারণায় নেমে পড়ে। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দলও এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায়।সে অনুযায়ী তিন সিটিতে মেয়র প্রার্থীর নামও ঘোষণা করে তারা। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জাসদ) নির্বাচনে তাদের দলীয় মেয়র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে।বাম ঘরানার দুই প্রধান দল সিপিবি এবং বাসদও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। তারাও ঢাকার দুই অংশেই মেয়র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। নির্বাচনকে ঘিরে এত সাজ সাজ রবের মধ্যে এতদিন অনেকটাই নীরব ছিল বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসতেই তারাও নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল। ২০০৭ সালের ১৪ মে সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় ৮ বছর পর আবার ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে ঢাকা সিটিতে। তবে এবার অবিভক্ত নয়, বিভক্ত সিটিতে নির্বাচন হবে। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ নামে সিটি কর্পোরেশন ভাগ হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে ২৬ জুলাই। আইনানুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। ওই হিসাবে ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৬ জুলাইর মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা।ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম সিটিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির এবং জাতীয় পার্টি থেকে সোলায়মান আলম শেঠকে দলের মেয়র প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। ঢাকার দুই অংশেই আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে অনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হলেই বিএনপিও তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে।জানা গেছে, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে মেয়র এবং কাউন্সিলরদের জয়ী করার চ্যালেঞ্জকে আন্দোলনের সাফল্য হিসেবে দেখানো যাবে। আর জয়লাভে ব্যর্থ হলে সরকারের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগে আন্দোলন জোরদার করা সহজ হবে। দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের শীর্ষ নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর পূর্তির দিন থেকে অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি থেকে হরতাল-অবরোধ দিয়ে টানা আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন। সেখান থেকেই আন্দোলনের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গ্রেফতারি পরোয়ানা উপেক্ষা করেই সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনড় খালেদা জিয়া।এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৮ মার্চ পর্যন্ত বিএনপির টানা আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধে ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৬৬ জন।ক্রসফায়ার, গুলিবিদ্ধ, গণপিটুনি ও ট্রাকচাপায় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন ৬৩ জন। গুম হয়েছেন ৩৬ জন। নিখোঁজ রয়েছেন ১৮ জন। পঙ্গু হয়েছেন ৫০ জন। মামলা হয়েছে ১৪ হাজার। গ্রেফতার ও আটক হয়েছেন ১৬ হাজার। দিন যত বাড়ছে নিহত এবং আহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। টানা হরতাল-অবরোধে সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কৃষক-শ্রমিক- খেটে খাওয়া দিনমজুরসহ সাধারণ মানুষ পথে বসেছে। শিক্ষা ব্যবস্থা হরতাল-অবরোধে তছনছ হয়ে গেছে।
এরকম পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ, কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা দুই শীর্ষ নেত্রীর সঙ্গে বারবার দেখা করে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও বারবার সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন দুই দলকে। খালেদা জিয়া এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চমক হিসেবে তিন সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীনরা। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তফসিলও ঘোষণা করে। এর পরপরই দ্রুত বদলাতে থাকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। বিএনপি এখনও হরতাল-অবরোধ বহাল রেখেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। নির্বাচনে অংশ নিলে তারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করবে।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ১ হাজার ৯শ’ প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ইতোমধ্যে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। বেশ জোরেশোরে তারা জনসংযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের পক্ষ থেকে পাড়ায় মহল্লায় গঠন করা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। অন্যদিকে মেয়র পদে বিএনপির তিন নেতা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে তারা এখনো নীরব। বিএনপি দলীয়ভাবে এখনো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয় নি। এ জন্য তাদের প্রার্থীরা এখনো নির্বাচনী মাঠে নেই। নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হলে পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে বলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা মনে করছেন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা মাঠে থাকলে নির্বাচন প্রাণবন্ত হবে এমনটা প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গত ৭ দিনে ১ হাজার ৯০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে। এদের মধ্যে ৪৯ জন মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া দুই সিটির মধ্যে উত্তরে ৭৭০ জন এবং দক্ষিণে ১ হাজার ৮১ জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে নিয়ে মনোনয়পত্র সংগ্রহ করেও শঙ্কায় রয়েছে অনেকে।
সরকারদলীয় প্রার্থীরা আগে থেকে প্রচারণা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তো রয়েছেই। দক্ষিণে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন লাভ হয়নি। তবে উত্তরে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পরের দিন তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে দারুন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার সমর্থকরা। এছাড়াও দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই দুই সিটিতে বিএনপির আসন্ন ঢাকা সিটি দক্ষিণের নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসসহ ৪ জন নেতা ফরম নিয়েছেন।গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে অবস্থিত দক্ষিণের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন অ্যাডভোকেট একেএম শাহজাহান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন ও অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম।অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, মির্জা আব্বাস নির্বাচনে প্রতদ্বন্দ্বীতা করবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে আমরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি।
তবে তাদের মতে, ফরম সংগ্রহ করে রাখা হলো জমা দেয়া হবে দলীয় সিদ্ধান্তে। দল নির্বাচনে আসলে উত্তরে মিন্টুকে সমর্থন দেয়ার বিষয় নিশ্চিত উল্লেখ করে তার এক সমর্থক বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত হলেই কেবল ফরম জমা দেয়া হবে। এছাড়া প্রচারণা দলীয় প্রভাব খাটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন উত্তরের আরেক প্রার্থী হেলেনা জাহাঙ্গীর গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অফিসে এসে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন তিনি। অন্যদিকে সিপিবি-বাসদের পক্ষেও নির্বাচনে গরিব- লোকদের অংশগ্রহণে আইনি বাধা তৈরি অভিযোগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যয় কমানো ও কালো টাকার ব্যবহার বন্ধে ইসি হস্ত ক্ষেপ কামনা করেন তারা। এসব দাবিও লিখিতভাবে ইসিতে জমা দিয়েছেন তারা। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে দক্ষিণে শোকজ করা হয়েছে এমন একজন কাউন্সিলর প্রার্থী শঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, একজন মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগ দিয়েও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। অথচ আমাদের ছোট-খাটো ভুলের জন্য প্রার্থিতা বাতিলের হুমকি দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া হাজি সেলিমের এমপি পদ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করার ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, বুধবার পর্যন্ত মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর এই তিন পদে ১১০৮ জন আগ্রহী প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এদের মধ্যে ২৭ জন মেয়র পদে, ৯১৩ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৬৮ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, বুধবার পর্যন্ত মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর এই তিনটি পদে ৭৯২ জন সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়পত্র সংগ্রহ করেছেন। এদের মধ্যে ২২ জন মেয়র পদে, ৬৩৪ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৩৬ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
গত ১৮ মার্চ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে ১৯ মার্চ থেকে শুরু হয় মনোনয়নপত্র বিক্রি। তবে নির্বাচনী আমেজে ফিরে আসে মঙ্গলবার। আগেরদিন উত্তরে আনিসুল মনোনপত্র নিলেও পরেরদিন সরকারদলীয় সাবেক এমপি সারাহ বেগম কবরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যাবসায়ি আব্দুল আওয়াল মিন্টু, এখলাস উদ্দিন মোল্লা, হেলেনা জাহাঙ্গীর, বিকল্পধারা মাহী বি. চৌধুরী, জাতীয় পার্টির বাহাউদ্দিন বাবুল, ববি হাজ্জাজ, সিপিবির আব্দুল্লাহ আল কাফি (কাফি রতন) সহ ২২জন প্রার্থী মনোনয়ণ সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও দক্ষিণে আওয়ামী লীগের সাঈদ খোকন, হাজি সেলিম, বিএনপির মির্জা আব্বাস, নাসির উদ্দিন পিন্টু, আব্দুস সালাম, জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, ইসলামী আন্দোলনের আব্দুর রহমান, সরকারি দলের সাবেক এমপি গোলাম মওলা রনি, বাহরানে সুলতানসহ ২৩ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তাদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের মাধ্যমে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।এ প্রসঙ্গে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“পের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুল আলিম বলেন, নির্বাচনে যতো বেশি প্রার্থী থাকবে ভোটারদের কাছে সৎ, যোগ্য বিকল্প প্রার্থী বাছাইয়ে তত সুবিধা হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনের উচিত সব বাধা দূর করে নির্বাচনের প্রার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা।
অন্যদিকে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার করেছে বিএনপি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র তুলেছেন দলটির কয়েকজন নেতা।ঢাকা উত্তরে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টুর পক্ষে তার দুই ছেলে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ঢাকা দক্ষিণে মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ডেপুটি মেয়র আবদুস সালামের পক্ষে মনোনয়ন সংগ্রহ করেন বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম। ওদিকে চট্টগ্রামে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বর্তমান মেয়র এম মনজুর আলমের পক্ষে আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেছে বিএনপিপন্থি সংগঠন চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন। পরে শুক্রবার চট্রগ্রামে মেয়র পরে এম মনজুর আলমের পক্ষে আনুষ্ঠানিক সমর্থন করে বিএনপি। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণে কর্মী-সমর্থকরা যে দুইজনের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তাদের মধ্যে আবদুস সালাম বর্তমানে বিদেশে ও নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু কারাগারে রয়েছেন। আবদুস সালামের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পর মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি এখনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদি দল নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তখন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ৬ দফা পরামর্শসহ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে বিএনপি সমর্থক বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন শত নাগরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে শত নাগরিকের প্রতিনিধি দলটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি স্বার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলটিকে আশ্বস্ত করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে চট্টগ্রামের মতো ঢাকায়ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতে পারে। এদিকে দলের পক্ষ থেকে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল। তিনি বলেছেন, দলের পক্ষ থেকে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে চেয়ারপারসনের সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আলোচনা করেছেন। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচনে গেলে সমর্থনের বিষয়টিও দলের পক্ষ থেকে জানানো হবে।
তবে বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন শত নাগরিক-এর কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় তার ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়ার কারণে তারা এ বিষয়ে আলোচনা ও উদ্যোগ নিয়েছেন। চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়টিই আজকালকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে বিএনপি। দলটি এখন শেষ মুহূর্তে সরকারের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করছে ২০ দল। নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি-সমর্থক শত নাগরিকের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাদের মাধ্যমেই মূলত নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ও মনোভাব বুঝতে চাইছে বিএনপি। সিটি নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ায় দলীয় প্রতিনিধির বদলে বিশিষ্ট নাগরিকদের এ প্রতিনিধি দলকে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, নেতাকর্মীরা নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। এ ব্যাপারে সরকার ও নির্বাচনের কমিশনের ভূমিকা ও আচরণেই নির্ভর করছে সবকিছু। বিএনপির তরফে সরকারের প্রতি কৌশলগত বার্তা দেয়া হয়েছে এখন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন বিষয়গুলো কিভাবে দেখছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তরে প্রার্থী সমর্থনের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হলেও দক্ষিণে পছন্দসই মেয়র প্রার্থী নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এছাড়া মহানগর নেতাদের বেশির ভাগই মামলার আসামি হওয়ার কারণে কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। এদিকে সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়ার পর দলের নেতারা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও এখন পর্যন্ত তার প্রভাব পড়েনি তৃণমূলে। তফসিল ঘোষণার ৬দিন পেরিয়ে গেলেও রাজধানীতে বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য মেয়র ও ওয়ার্ড কমিশনারদের তেমন কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। পোস্টারিং, ব্যানার, মসজিদে মসজিদের দোয়া মাহফিল আয়োজন বা নিজ নিজ এলাকার মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ শুরু করেননি। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও দেখা যায়নি উৎসাহ-উদ্দীপনা। গ্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি ও সরকার দলীয় কর্মী-সমর্থকদের রোষের ভয়ে নিরাপদ অবস্থানে থেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী দলের মহানগর ওয়ার্ড পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশ গ্রেপ্তার ও হয়রানি করবে না- এমন নিশ্চয়তা না পেলে তাদের পক্ষে জনসংযোগ বা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা কঠিন হবে।