দৈনিকবার্তা-নারায়ণগঞ্জ, ২৭ মার্চ: নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় সনাতন সম্প্রদায়ের পুণ্যস্থান লাঙ্গলবন্দে অষ্টমীর পুণ্যস্নানের সময় পদদলিত হয়ে সাত নারীসহ ১০ জন পুণ্যার্থী মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের বেশি। শুক্রবার সকাল সোয়া নয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলামের দেওয়া ভাষ্য, সকালে পুণ্যস্নানের পদযাত্রায় প্রচণ্ড ভিড় হয়।তখন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাশাপাশি রাজঘাট ও প্রেমতলা ঘাটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদিকে, পুণ্যার্থীদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।নিহতদের সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।কয়েকজন পুণ্যার্থী অভিযোগ করেন, পুণ্যার্থীদের ভিড় সামলাতে ওই এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন না। স্নানের সময় অনেকটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ সময় পুণ্যার্থীরা পদদলিত হন। লাঙ্গলবন্দে এখনো পুণ্যস্নান চলছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া বলেন, শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে স্নান উৎসব শুরু হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুণ্যার্থীদের ঢল নামে।লাঙ্গলবন্দের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রায় ১৬টি ঘাটে স্নানের ব্যবস্থা করলেও রাজঘাটে স্নানের জন্য পুণ্যার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। ওই ঘাট এলাকায় সকাল পৌনে ৮টার দিকে ভিড়ে পদদলিত হয়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।পাশের একটি বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজব ছড়ানোয় হুড়োহুড়ির মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।নিহতদের মধ্যে মাদারীপুরের নিতাই চন্দ্র দাশ (৬০) ও নকুল বিশ্বাস (৫৩), কুমিল্লা জেলার চান্দিনার রঞ্জিত মল্লিক (৪৮), দাউদকান্দির কানন সাহা (৫২), মেঘনা থানার তুলসী দেবনাথ (৫৫), রাজধানীর ধানমণ্ডি জিগাতলার ভগবতী দাশ (৪০), লালবাগের রাখি চন্দ্র দাশ (২৫), মানিকগঞ্জের মালতী দাশ (৬০), নোয়াখালীর কবিরহাটের ভানুমতি দাশ (৪০) এবং সুচিত্রা সেনের (৪৮) মৃত্যু হয়।সকালে রাজঘাটে যাওয়া-আসার পথে যথাযথ শৃঙ্খলা না থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন অভিযোগ করেছেন।এছাড়া আহতদের হাসপাতাল-ক্লিনিকে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স না মেলায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।শৃঙ্খলা ঘাটতির অভিযোগ অস্বীকার করে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, এ অভিযোগ ঠিক নয়। দুর্ঘটনার পর পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে বলে কেউ অভিযোগ করলে তা সত্য নয়।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টম তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এই স্নান উৎসব হয়। ১৫ লাখের বেশি পুণ্যার্থী স্নানের মধ্য দিয়ে পাপ মোচনের লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র তীরে আসেন।কচুরিপানায় নদ ভরে যাওয়ায় নির্বিঘ্নে স্নান নিয়ে আগেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আয়োজকরা।লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাসু দেব চক্রবর্তী শুক্রবার ভোরে বলেন, কচুরিপানা পরিস্কার করলেও আবার তা ভরে গেছে। এরইমধ্যে পুণ্যার্থীদের ঢলে আমরা তো মানুষের জীবন নিয়েই চিন্তিত হয়ে গেছি।হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য তুমি আমার পাপ হরণ কর- এ মন্ত্র উচ্চারণ করে দূর্বা ঘাস, বেল পাতা, কলা, আম, ডাব ও ফুল দিয়ে পাপ মোচনের বাসনায় ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যার্থীরা ব্রহ্মার কাছে কৃপা প্রার্থনা করে স্নান করছেন।শনিবার ভোর ৬টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে লগ্ন শেষ হওয়া পর্যন্ত স্নান উৎসব চলবে বলে বাসু দেব জানিয়েছেন।উৎসব ঘিরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মহিলাদের কাপড় বদলানোর কক্ষ, বিশুদ্ধ পানির জন্য ৫০টি টিউবওয়েল, ৭০টি টয়লেট এবং ৩৫টি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র ও বিনামূল্যে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়া এই উৎসব উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দে তিন দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পূণ্যস্নান উৎসবে পদদলিত হয়ে ১০জনের প্রাণহানিতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবাণীতে প্রধানমন্ত্রী সকল বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবাণীকে এ কথা বলা হয়েছে।এদিকে, নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে পূণ্যস্নানে পদদলিত হয়ে নিহতদের প্রত্যেককে ২৫হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছে জেলা প্রশাসন।শুক্রবার দুপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের রাজঘাট ঘটনাস্থলে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের হাতে জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান এ অনুদান তুলে দেন।এসময় ঢাকা রেঞ্জের এডিআইজি শফিক আহমেদ, পুলিশ সুপার ড. মুহিদ উদ্দীন আহমেদ, স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান,নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তর করা হচ্ছে।শুক্রবার ভোর থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র অষ্টমীস্নান শুরু হয়েছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে হাজারো পূণ্যার্থীর এ স্নান চলবে শনিবার ভোর পর্যন্ত।পূণ্যস্নান উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকেই বন্দর থানার লাঙ্গলবন্দে হাজার হাজার পূণ্যার্থীর ঢল নামে।নিজেদের পাপ মোচনের জন্য প্রার্থনায় অংশ নিতে দেশের বাইরে থেকেও অনেকে পূণ্যার্থী এসেছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।