2015-03-26_6_118566

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৬ মার্চ: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিহত করে উন্নত দেশ গড়ার শপথের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সারাদেশে নানা আয়োজনে যথাযোগ্য মর্যাদায় ৪৪তম মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়েছে।বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, জেলা প্রশাসন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়।এ সকল কর্মসূচির মধ্যে ছিল বৃহস্পতিবার ২৬ মার্চ সূর্যোয়ের সাথে সাথে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৩১ বার তোপধ্বনি, স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, প্যারেড, কুচকাওয়াজ, মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, এতিমখানা ও কারাগারে উন্নত খাবার সরবরাহ, আলোচনা সভা ।যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন এবং জঙ্গীদের নির্মূলে অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত।

যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন,জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার দাবী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার গ্রহণের মধ্যদিয়ে বৃহষ্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়েছে।স্বাধীনতার ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় এবং সারাদেশে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হয়। এসব কর্মসূচি থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি সম্মিলিত কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনের।

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতি উদযাপন করে এই দিনটিকে। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্যে ছিল জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজ ও ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সরকারি ভবনে আলোকসজ্জা, দেশজুড়ে মসজিদ, মন্দির ও প্যাগাডোয় দেশের কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলাখানা, সরকারি শিশুসনদসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠান সমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।

সকালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।ভোর ৬টায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড-অব-অনার প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন।
প্রধানমন্ত্রী পরে আওয়ামী লীগ মন্ত্রী পরিষদ, উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।এ সময় প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, চিফ হুইপ, সাংসদ, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিক, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্য, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

দিনটি ছিল সরকারি ছুটির দিন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও সরকদ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকাসহ বিভিন্ন পতাকায় সজ্জিত করা হয়। দিবস টি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে এং বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, এবং বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে।এদিকে সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী কুচকাওয়াজসহ বিভিন্ন শরীরচর্চা প্রদর্শন করে। প্রধান অতিথি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুচ-কাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন।

এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী বাংলাদেশ শিশু একাডেমীসহ বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাকাটিকিট প্রকাশ করে।এদিকে সকালে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিদেবন করে।সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রক্ষিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তিনি শ্রদ্ধা জানান। সকাল থেকে দলীয় নেতা-কর্মীসহ অনেক শ্রেণী-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জড় হন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে।

এছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, যুবলীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ছত্রলীগ মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, মৎস্যজীবী লীগ, যুব শ্রমিক লীগ, হকার্স লীগ, তাঁতী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, মোটরচালক লীগ, ওলামা লীগ, জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে।দিবসটি উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ছায়ানট, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রেসক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ঢাকা, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, ঢাকা মহানগরী সমিতি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিস্তাররিত কর্মসূচি গ্রহণ করে।

দীর্ঘ ৯ মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু একটি স্বাধীন দেশই পাইনি, পেয়েছি নিজস্ব স্বকীয়তা। অর্জন করেছি আলাদা জাতিসত্তা। বিশ্বের বুকে নিজেদের পরিচিত করিয়েছি নতুন উচ্চতায়। আর এ স্বাধীনতার ফলে সেই আলাদা জাতিসত্তা, নিজস্ব স্বকীয়তা, বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রতীক হিসেবে পতপত করে উড়ছে আমাদের জাতীয় পতাকা।জাতীয় পতাকার মর্যাদা এক অনন্য উচ্চতায় অভিষিক্ত। এর মূল্যও বাঙালির কাছে এক ব্যতিক্রমী তাৎপর্যের। অতি সহজে আসেনি এ প্রাণের পতাকা। ৩০ লাখ মানুষের জীবন বিসর্জন আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা এ পতাকা অর্জন করেছি। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস লিখেছি নতুন করে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালি, জাতীয় পতাকা বুকে ধারণ করে জাতিসত্তার স্বকীয়তার প্রমাণ রেখেছে সেই ১৯৭১ সালেই। সেই পতাকা বহনের গর্বিত উত্তরাধিকার পেয়েছে আজকের নতুন প্রজন্ম। কাল থেকে কালান্তরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কোটি বাঙালি বুকে ধারণ করে চলবে এই লাল-সবুজ পতাকার গৌরব।

৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সাভারের গাজীর চর ইপিজেড এলাকা থেকে একটি যৌথ পরিবারের ৯ জন সদস্য এসেছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বীর শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পরিবারের সবাই লাল-সবুজের পতাকায় মোড়ানো পোশাক পরে আসেন।

পতাকায় মোড়ানো পোশাক পরে আসা প্রসঙ্গে ওই পরিবারের সদস্য মোছা. শামসুন্নাহার বলেন, নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এতে লাখ শহীদ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই আমরা এখানে এসেছি। পরিবারের নবীন সদস্যদের এখানে নিয়ে এসেছি তারা যাতে করে শহীদদের চেতনা মনে প্রাণে ধারন করে।শামসুন্নাহারের মেয়ে তুলি (১৪) ও ছেলে ফাহিমও (১০) লাল-সবুজের পাতাকা পরে ও গালে লাল-সবুজের পতাকা এঁকে স্মৃতসৌধে আসে।

বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম ম্রেণীর শিক্ষার্থী ফাহিম জানায়, ২৬ মার্চে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করতে এসেছি।একই সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন, সাম্মী সরকার, বায়েজিদ সরকার, ফাতেমা আক্তার ও মাহিমা আক্তার।সাম্মী সরকার বলেন, যৌথ পরিবারের সকল সদস্য মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের গভীরভাবে স্মরণ করতে লাল-সবুজের পতাকায় মোড়ানো পোশাক পরে এখানে এসেছি। কারণ তাদের ত্যাগেই আমরা এই পতাকা পেয়েছি।

জাতির সবচেয়ে বড় অর্জনের আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনার এক আবেগঘন মিশ্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও মুক্তিকামী লাখো মানুষ নানা ব্যঞ্জনায় পালন করে দিনটি। ফুলে ফুলে ভরে উঠে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ মিনার। স্মরণ করে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তার সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। বজ্রমুষ্ঠিতে শপথ নেয়- এ দেশকে সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার।মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পৃথক পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান।

স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আজ বিশ্বময় ছুটছে বাংলাদেশের জয়যাত্রা। বিশ্বের অনেক দেশই এখন মনে করছে, অচিরেই বাংলাদেশ নামক মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটি পরিণত হবে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে। তারুণ্যের শক্তি আর প্রবীণের প্রজ্ঞা- এ দুইয়ে মিলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। যেমনটি পারেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালে আধুনিক সমারাস্ত্রে সজ্বিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপক্ষে দেশপ্রেম ও অসীম সাহসীকতা নিয়ে লড়েছিল বীর বাঙাল। আজো তারা লড়ছে, ভবিষত্যেও লড়বে- কারণ, বাঙালি মাথা নত না করা এক জাতির নাম সাভারে শহীদ মিনারে হাজারো মানুষ এমনই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।