দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ মার্চ: প্রায় দুই মাস পর হরতাল থেকে মুক্তি মিললেও রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে ফিরে এসেছে যানজটের দুর্ভোগ। কয়েকদিন ধরে রাজপথে বাড়তে থাকা যানবাহনের চাপ বুধবার তীব্র আকার ধারণ করে।সকাল থেকেই গুলিস্তান, শাহবাগ, ফার্মগেইট, বিজয় সরণী, মহাখালী, মগবাজার ও সদরঘাট এলাকায় যানবাহনের ভিড় দেখা দেয়।বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সড়ক যানজটে কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
এদিকে,মাস খানেক আগেও রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসের সামনে ডাবভর্তি ঝুড়ি নিয়ে অলস সময় পার করতেন বিক্রেতা আবুল কাশেম। তখন বেচাকেনা ছিল হাতেগোনা। হাঁকডাক আর দাম কমিয়ে কোনোমতে চালান তুলতেন তিনি। তবে দিন বদলেছে। এখন ৩০ টাকার নিচে একটি ডাব বেচেন না তিনি।দিন বদলের রহস্য কী? দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ডাব-বিক্রেতা কাশেম বলেন, ভাই, গরম পড়ছে না। মাইনষে ডাব খাইব না তো খাইব কী? কাশেমের পাশেই বিরামহীন হাত চলছে হোসেন আলীর। কেটে-ছিলে খিরাইয়ে লবণ লাগান তিনি। একেকটি খিরাই বেচেন পাঁচ টাকায়। তাঁর কাছ থেকে একটি খিরাই কিনে ঘাম-চপচপে হাতে নিয়ে খাচ্ছিলেন রিকশাচালক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, শরীরডা পুইড়া যাইতাছে। খিরাই খাইয়া একটু ঠান্ডা হই। অহনই এই অবস্থা। সামনে তো বৈশাখ মাস পইড়াই রইছে!
পাসপোর্ট অফিসের কাছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঠান্ডা-গরমের সব খবর আছে সেখানে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, রাঙামাটি, ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও সিলেটের ওপর দিয়ে বুধবার মৃদু দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে।আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মাত্র একদিনের ব্যবধানে দেশের প্রায় সব এলাকায় তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তবে দাবদাহে বেশি তপ্ত উত্তরের জেলা রাজশাহী। গতকাল মঙ্গলবার সেখানে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন সোমবার রাঙামাটিতে দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। চৈত্রের উষ্ণতায় রাজধানী ঢাকার অধিবাসীদেরও গা পুড়ছে। সোমবার থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়ে ৩৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে হয়েছে ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল বরিশালে ৩৪ দশমিক ৮, খুলনায় ৩৬, সিলেটে ৩৬ দশমিক ৭, রংপুরে ৩৫ দশমিক ২ ও চট্টগ্রামে ৩৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
উষ্ণতার এই সময়েও বৃষ্টি মুখ লুকিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও একফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২১ মার্চ সবশেষ বৃষ্টি হয়েছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি এলাকায়।
শুধু কী তাই, চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় চলে এলেও ঝড়ের দেখা নেই। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড় ও শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। আজ কয়েকটি এলাকায় অল্পস্বল্প বৃষ্টি হতে পারে। এতে তাপ খানিকটা কমতে পারে।তাপ কমার কথা শুনে হাঁপ ছাড়ার উপায় নেই। সামনে আরও গরম পড়বে বলেই সতর্ক করেছেন আবহাওয়াবিদ। এপ্রিলকে দেশের উষ্ণতম মাস উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, এ মাসে হয়তো তাপমাত্রা আর বাড়বে না। তবে এপ্রিল মাসে বেশ কয়েকটি দাবদাহ বয়ে যেতে পারে। তাই সামনে আরও গরম পড়বে।
গত ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ এবং ফেব্র“য়ারির শুরু থেকে সপ্তাহের ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই হরতাল করে আসছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। এরমধ্যে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের পর বিজয় মিছিলের জন্য একদিন হরতাল ১২ ঘণ্টা শিথিল করা হলেও অবরোধ চালিয়ে যায় আগাম নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা দলটি।
প্রায় তিনমাস ধরে চলা এসব কর্মসূচিতে যানবাহন লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতার কারণে শুরুর দিকে জনমনে আতঙ্ক ও চলাচলে অস্বস্তি কাজ করলেও মাসখানেক আগে থেকে পরিস্থিত পাল্টাতে থাকে।জনজীবনে হরতালের তেমন কোনো প্রভাব না থাকায় রাস্তায় যান চলাচল বাড়তে শুরু করে এবং প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরকেও একদিন কিছু সময় যানজটে আটকে থাকতে হয়।
এতোদিন অজ্ঞাত স্থান থেকে বিএনপির নামে বিবৃতি পাঠিয়ে রোববার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত হরতাল ডেকে পরে তা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাড়ানোর বার্তা দেওয়া হচ্ছিল। তবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে মঙ্গলবার বিএনপির বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলুর নামে যে বিবৃতি পাঠানো হয় তাতে হরতাল এড়িয়ে অবরোধ ও মিছিলের কর্মসূচি দেওয়া হয়।
দীর্ঘদিন পর হরতালমুক্ত একটি কর্মদিবস পেয়ে বুধবার সকাল থেকে অস্বস্তি ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়ে আসে রাজধানীবাসী। সকাল সোয়া ৮টার দিকে শাহবাগ থেকে বাসে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আনোয়ারের মহাখালী পৌঁছাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।আনোয়ার বলেন, সোনারগাঁও মোড়, বাংলামটর, পান্থপথ, ফার্মগেইটসহ প্রায় সবকটি চৌরাস্তায় গাড়ির জট। পুরো রাস্তাই গাড়ি চলছে খুব ধীর গতিতে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সকাল ৯টায় মিরপুর সাড়ে ১১ থেকে যাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে তার সময় লেগেছে দুই ঘণ্টার বেশি। পথে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিজয় সরণী, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও গুলিস্তান এলাকায় তীব্র যানজটের মুখে পড়েছে তার গাড়ি।
গুলিস্তান থেকে সদরঘাট এবং সদরঘাট থেকে গুলিস্তানমুখী সড়ক, নয়া বাজার, রায় সাহেব বাজারের সড়কগুলোতেও সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা যায় ।গুলিস্তান ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সার্জেন্ট মশিউর রহমান বলেন, অন্য দিনের তুলনায় রাস্তায় গাড়ির চাপ একটু বেশি বলেই মনে হচ্ছে।
টঙ্গীর আব্দুল্লাপুর থেকে সদরঘাটের পথে চলাচলকারী আজমেরী পরিবহনের চালক সেন্টু মিয়া জানান, হরতালের মধ্যেও তিনি গাড়ি চালিয়েছেন। তবে বুধবার গাড়ির চাপ অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী নাজির আহমেদ বলেন,আজ হরতাল নেই, এ কথাটা ভাবতে ভালো লাগছে। দীর্ঘদিন ধরে অলিগলিতে হাতবোমা বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন ও অন্যান্য নাশকতার আশঙ্কা নিয়ে মানুষ চলাফেরা করেছে। এখন সেই আতঙ্ক কেটে যাওয়ায় সবাই নির্বিঘেœ রাস্তায় বেরিয়েছে।অবশ্য সারোয়ার নামে পুরান ঢাকার অরেক ব্যবসায়ী বলেছেন, এতোদিন হরতাল থাকার বিষয়টি তিনি আমলেই নেননি। নিজের মতো করিই স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা করে গেছেন।হরতাল না থাকলেও বিএনপি জোটের অবরোধ এখনো আছে। তাই পুলিশ অন্যান্য দিনের মতোই সতর্ক রয়েছে বলে জানালেন বংশাল থানার ওসি আব্দুল কুদ্দুস ফকির।