দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ মার্চ: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মেয়র পদে সাঈদ খোকন শেখ হাসিনার সমর্থন পাওয়ার কথা জানালেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী হাজি মোহাম্মদ সেলিমকে পাশে রেখে মহানগরের শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রার্থিতার বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি৷স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি ঠিক করতে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় একথা বলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও কামরুল ইসলাম, মহানগর কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের এই দুই নেতা শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভারও সদস্য৷
সহ-সভাপতি ফয়েজ উদ্দিন মিয়ার সভাপতিত্বে এই সভায় সাধারণ সম্পাদক মায়া এবং যুগ্ম সম্পাদক কামরুলের পাশাপাশি আরেক যুগ্ম সম্পাদক হাজি সেলিমও ছিলেন৷ উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি মুকুল চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ৷ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের ছেলে কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খোকন এই সভায় ছিলেন না৷ বর্ধিত সভা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সাঈদ খোকন কার্যালয়ে ঢোকেন৷ তার সঙ্গে ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ৷
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তোড়জোড়ের মধ্যে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ডেকে নেন সাঈদ খোকনকে৷ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে দলের পক্ষ থেকে সমর্থন পাওয়ার কথা পরে সাংবাদিকদের জানানও ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের এই ছেলে৷সাঈদ খোকনের মতোই ঢাকা দক্ষিণে প্রচার চালিয়ে আসছিলেন হাজি সেলিম৷ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে লড়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া হাজি সেলিম এখন মেয়র হতে চান, যদিও সেক্ষেত্রে তাকে সংসদ সদস্য পদ ছাড়তে হবে৷২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নিতে মঙ্গলবার সাঈদ খোকনের পাশাপাশি হাজি সেলিমও মনোনয়নপত্র কেনেন৷ খোকন দলের সমর্থন পাওয়ার কথা জানালেও হাজি সেলিম সাংবাদিকদের বলেন, তার বিশ্বাস যে শেষ পর্যন্ত দলের সমর্থন তিনিই পাবেন৷ গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে মনোনয়নপত্র কেনার কয়েক ঘন্টার মধ্যে কয়েকশ গজের মধ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা বসে, যাতে উপস্থিত হন হাজি সেলিম৷
ওই সভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মায়া বলেন, ২৯ মার্চ মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার পর নেত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন৷ নেত্রী যাকে সমর্থন দেবেন, তার পক্ষেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে৷এর বাইরে কেউ নির্বাচন করলে নগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থাকবে না৷ তা তিনি নিজ দায়িত্বে করবেন৷কামরুল বলেন, প্রার্থী এখনও চূড়ান্ত নয়৷ এ বিষয়ে নেত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন মনোনয়নপত্র দাখিলের পর৷ আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব৷
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে একই রকম ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল৷ সেখানে এ কে এম শামীম ওসমান দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানালেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দলেরই নেতা সেলিনা হায়াত্ আইভী৷ওই নির্বাচনে শামীমকে হারিয়ে আইভী মেয়র নির্বাচিত হন৷ ভোটের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শামীম কিংবা আইভী কোনো প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা ছিল না৷মন্ত্রী কামরুল বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ায় এখানে কোনো প্রার্থীকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ নেই৷ তবে সমর্থন করা যায়৷প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে যাকে সমর্থন দেওয়া হবে, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে জয়ী করে আনব৷মায়াও বলেন, মূল সমর্থন আসবে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে৷ তিনি সমর্থন দেবেন, আমরা কাজ করব৷ এখানে কোনো ফাঁক-ফোকর নেই৷এই দুই মন্ত্রীই আশা করছেন, সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বর্তমানে আন্দোলনে থাকা বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচেনে আসবে৷ আমরা চাই, সবাই নির্বাচনে আসুক৷ বিএনপিকে বলব, সন্ত্রাসীদের নিয়ে নয়, ভালো মানুষদের নিয়ে নির্বাচনে আসুন৷ আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত, বলেন মায়া৷
দক্ষিণের মনোনয়নপত্র নিলেন খোকন,সেলিম: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বনি্দ্বতার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা সাঈদ খোকন ও হাজী সেলিম৷ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে খোকনকে সমর্থনের কথা এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে৷তবে পুরান ঢাকার সাংসদ হাজী সেলিমের দাবি, ঢাকাইয়ারা তাকে মেয়র পদে প্রার্থী দেখতে চায়৷এর আগে গত বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রর্থী হিসেবে দলীয় প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি৷
মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়নপত্র তোলেন সাঈদ খোকন৷এ সময় সাংবাদিকদের কাছে সম্ভাব্য এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘনের অভিযোগ করেন তিনি, যাতে মূলত হাজী সেলিমকেই ইঙ্গিত করা হয়৷ খোকন বলেন, অনেকেই আগাম প্রচারণা চালাচ্ছে৷ অস্ত্র ও পেশী শক্তি প্রদর্শন করে সাধারণ ভোটারদের ভয় দেখানো হচ্ছে৷ এগুলো সুস্পষ্ট নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘন৷এর ঘন্টাখানেক পরে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে আসেন হাজী সেলিম৷
খোকনের অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, উনি যা বলতে পারেন আমি তো বলতে পারি না৷ আমি এমপি-এখন রাস্তায় দাঁড়ালে যদি আমার সাথে এক/দেড়শ লোক দাঁড়িয়ে যায় সে কি আমার দোষ?নির্বাচনে প্রতিদ্বনি্দ্বতার কারণ ব্যাখ্যায় হাজী সেলিম বলেন, ঢাকাবাসী, ঢাকাইয়ারা চায় আমি মেয়র পদে নির্বাচনে দাঁড়াই৷ তাই মনোনয়নপত্র নিলাম৷
আওয়ামী লীগ থেকে সাঈদ খোকনকে সমর্থন দেওয়ার পরেও তিনি প্রার্থী হওয়ায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগের, আমি দলের মানুষ৷ দল এখনো যাচাই-বাছাই করছে৷আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত দল আমাকেই সমর্থন করবে৷ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, মেয়র পদে প্রতিদ্বনি্দ্বতার জন্য এ পর্যন্ত ১৩ জন তাদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন৷এছাড়া এখনো যাদের ব্যানার- পোস্টার তুলে ফেলা হয়নি এমন ২৬ জন সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে৷
মঙ্গলবার পাঠানো ওই নোটিশে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাদের ব্যানার- পোস্টার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান মিহির সারওয়ার৷ এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কারাবন্দি মাহমুদুর রহমান মান্নার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে৷মান্নার সংগঠন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আতিকুল ইসলাম আতিক মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে আগারগাঁওয়ে ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন৷
এরপর সংগঠনের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শহীদুল্লাহ কায়সার সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মাহমুদুর রহমান মান্নার পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছি৷ আইনজীবীর মাধ্যমে এটা কারাগারে পাঠানোর পর বিধি মোতাবেক জমা দেওয়া হবে৷নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্নার জয়ের আশা প্রকাশ করে সংগঠনের এই নেতা বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আমাদের বিজয় অবশ্যাম্ভাবী৷ আমাদের জনসমর্থন রয়েছে৷ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মান্না রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছেন৷
গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবরোধ ডাকার পর নাশকতায় ব্যাপক প্রাণহানির মধ্যে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য প্রধান দুই দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মান্না৷ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মাইনাস টু ফর্মুলার’ সমর্থক হিসেবে পরিচিতি পেয়ে দলীয় পদ হারাতে হয় তাকে৷নাগরিক সমাজের’ প্রতিনিধিদের ওই উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যে মান্নার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য এক ব্যক্তির টেলিফোন কথোপকথনের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ হয়৷
এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দিতার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ সারাহ্ বেগম কবরী, যদিও আগেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তিনি৷তার ব্যক্তিগত সহকারী শহীদুল ইসলাম মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে আগারগাঁওয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কবরীর পক্ষে মনোনয়নপত্র তোলেন৷এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, উনার (কবরী) অনেক জনপ্রিয়তা আছে৷ আশা করি উনি জিতে যাবেন৷
বাংলা চলচ্চিত্রের সাবেক অভিনেত্রী কবরী নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসন থেকে সাংসদ হয়েছিলেন৷দশম সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে কবরীর জায়গায় সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে মনোনয়ন দেয় দল৷ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন শামীম৷এরপর নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় শামীম-সেলিনা হায়াত্ আইভি উত্তাপ দেখা গেলেও দৃশ্যপটে দেখা যায়নি কবরীকে৷ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হককে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিলেও কবরীর প্রার্থী হওয়ার গুঞ্জন ছিল কয়েক দিন ধরে৷
ঢাকার দুই ভাগে এ পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি মেয়র পদে মনোনয়নপত্র কিনেছেন প্রার্থীরা৷ এখনো কেউ মনোনয়নপত্র জমা দেননি৷ ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটিতে ভোট হবে৷ এর আগে ২৯ মার্চ পর্যন্ত মনোনয়ন দাখিলের সুযোগ রয়েছে৷ এসব মনোনয়নপত্র ১ ও ২ এপ্রিল বাছাই শেষে প্রত্যাহারের শেষ সময় রয়েছে ৯ এপ্রিল৷