দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ মার্চ: ডিএমপি’র গোয়েন্দা ও অপরাধতথ্য বিভাগ রাজধানীর মতিঝিলে সংগঠিত চাঞ্চল্যকর শিমু হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে এবং এই ঘটনার সাথে জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো ১। মোঃ সাইদুল ইসলাম (২৭) ২। হানিফ (২৬) ৩। রাতুল আহাম্মেদ (২৩) ৪। নুরুন্নবী শাওন (১৯) ৫। মোঃ সুজন (২৩) ও ৬। মোঃ সুমন ওরফে তোতলা সুমন (২৪)। তাদের হেফাজত হতে ১টি ছুরি, ১টি চাপাতি, কাগজের তৈরী বল (স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো) যা দিয়ে ভিকটিমের মুখ বন্ধ করা হয়, ১টি কাঠের গুড়ি (খাইট্টা) যার ওপরে ভিকটিমের হাত, পা রেখে কাটা হয়, কেরোসিন তেল-এর বোতল ও আসামীদের পরিহিত রক্তমাখা শার্ট ও প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
উল্লেখ্য গত ১০/০৩/২০১৫ তারিখ মতিঝিল থানা পুলিশ ১৩.১০ টায় কালভাট রোডস্থ হোটেল উপবনের উত্তর পাশ থেকে মানুষের ১টি হাত ও ১টি পায়ের কাটা অংশ উদ্ধার করে। এর পর পুলিশ খোজাখুজির একপর্যায়ে পার্শ্বের ১৬৭/১ এশিয়াটিক ল্যারেটরিজ লিঃ ফকিরাপুলস্থ ওয়াসা ভবনের পাকা ওয়াল সংলগ্ন মাটি থেকে ১৩.৪০ টায় অজ্ঞাত মনুষ্য সদৃশ একটি পা এবং একই ওয়াল সংলগ্ন ৫ গজ পূর্বে ময়লা আবর্জনার উপর ১ টি হাত ও শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ১টি বাহু উদ্ধার করে। আশে পাশে খোজাখুজির একপর্যায়ে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির ওয়াসা ভবন মডস্ জোন-৬ এর পূর্ব পার্শ্বে হাফ বিল্ডিংস ওয়াসা স্টোর রুমের টিনের চালায় ১৪.২০ টায় একটি রক্ত মাখা সাদা বিছানার চাদর ও নীল রঙের নাইলোনের রশি দিয়ে পেচানো ও বাঁধা মানুষ সদৃশ মস্তক, হাত-পা বিহীন একটি দেহ উদ্ধার করে। এরপর আবার ১৫.১৫ টায় ১৯৩/১ ফকিরাপুল আহসান মঞ্জিল এর ৭ম তলার সিড়ির মাঝখানে একটি মানুষ্য সদৃশ মস্তক আগুনে পোড়া, ঝলসানো ও ছাইকালী মাখা অবস্থায় উদ্ধার করে। অজ্ঞাত পৃথক পৃথক অঙ্গগুলো একত্রিত করে একটি মহিলা সদৃশ দেহের অবয়ব পাওয়া যায়। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য অঙ্গগুলি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে প্রেরণ করা হয়। ঐ দিন উক্ত ঘটনায় মতিঝিল থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়।
মামলাটি তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপর ন্যস্ত হলে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে ঘটনার সাথে জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মোঃ সাইদুল ইসলাম, হানিফ, রাতুল আহাম্মেদ ও নুরুন্নবী শাওন বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান করে এবং মামলার রহস্য উদঘাটিত হয়।
আসামিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায় যে, ফকিরাপুল এলাকায় দীর্ঘদিন যাবত আসামী সুজন, রাতুল, শাওন, মিকি মাউস ওরফে আলম, তোতলা সুমন, বাংলা সোহেল, হানিফ, কালু, কানন-দের দলনেতা মোঃ সাইদুল ইসলামের নেতৃত্বে ইয়াবা ও হেরোইন ব্যবসা করে আসছে। এরা প্রত্যেকেই মোবারক হোসেন মন্টির বাসায় চার তলার ছাদে বসে নিয়মিত ইয়াবা সেবন করত। ভিকটিম সুমি ওরফে শিমু তাদের পূর্ব পরিচিত। সাইদুল ও মন্টিকে কয়েক বার ইয়াবাসহ ভিকটিম শিমু পুলিশের নিকট ধরিয়ে দেয়। এরপর থেকেই সাইদুল ও মন্টির সাথে ভিকটিম শিমুর বিরোধের সৃষ্টি হয়। ঘটনার ৪/৫ দিন আগে শিমুর স্বামী নাসির ইয়াবাসহ পুলিশের নিকট ধরা পরে এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক বছরের সাজা হয়। এই ঘটনায় শিমু সাইদুল, সুজন, হানিফ ও মন্টিকে দায়ী করে বিভিন্ন জনের নিকট বলে বেড়ায়।
গত ০৯/০৩/২০১৫ খ্রিঃ তারিখ রোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ০৭.০০ টায় সুজন, রাতুল, শাওন, মিকি মাউস ওরফে আলম, তোতলা সুমন, বাংলা সোহেল, হানিফ, সাইদুল সকলেই মন্টিদের বাসার ছাদে ইয়াবা সেবন করছিল। শিমু তখন ঐ বাসার নীচে হাটাহাটি করতে থাকলে উপর থেকে সুজন শিমুকে দেখে ফেলে এবং সাইদুলকে বলে ‘বস শিমু পুলিশ নিয়া আমাদেরকে ধরাইতে আসছে’। এই পর্যায়ে সুজন, হানিফ, নুরুন্নবী শাওন, সাইদুল নিচে নামিয়া শিমুকে ধরিয়ে ফেলে। শাওন কোলে তুলে নেয় আর বাকীরা কেউ মুখ চেপে ও কেউ হাত পা ধরে শিমুকে মন্টির বাসার ৬ষ্ঠ তলার ছাদের চিলে কোঠায় নিয়ে যায়। সবাই মিলে শিমুকে লোহার এঙ্গেলের সাথে নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধে। সুজন কাগজ মুড়িয়ে, স্কসটেপ দ্বারা পেঁচিয়ে বল বানিয়ে, ঐ বল মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে। ভিকটিম শিমুকে মন্টি জোর পূর্বক ইয়াবা সেবন করায়।
রাত অনুমান ০২.৩০ টা থেকে ০৩.৩০ টার মধ্যে ভিকটিম শিমুকে আসামী সাইদুল ইসলাম ও সুজন তাদের সাথে থাকা ছুরি দিয়া গলায় পোচ দিয়া জবাই করে। মোবারক হোসেন মন্টি তার বাসা থেকে চাপাতি ও রেতের মতো একটি ছুরি নিয়া আসে। মোবারক হোসেন মন্টি চাপাতি দিয়া শিমুর মাথাকে দেহ থেকে আলাদা করে। সুজন শিমুর ডান পা কাটে। রাতুল বাম পা কাটে। সাইদুল ও বাংলা সোহেল ডান হাত কাটে। হানিফ বাম হাত কাটে। মিকি মাউস ওরফে আলম ছুরি দিয়ে শিমুর পেটে আঘাত করে। বাংলা সোহেল ডান ও বাম হাত দুইটি ওয়াসার খালি জায়গায় ফেলে দেয়। সুজন ডান পা ও বাম পা হোটেল উপবন ও মোবারক হোসেন মন্টির বাসার চিপায় ফেলে দেয়। মোবারক হোসেন মন্টি শিমুর মাথাটা তার ঘর থেকে কেরোসিন তেল এনে আগুন দিয়ে পোড়ায় যাতে শিমুকে চিনতে পারা না যায়। সাইদুল, শাওন, তোতলা সুমন, বাংলা সোহেল, রাতুল, হানিফ মোবারক হোসেন মন্টি, আলম, সুজন সবাই মিলে মোবারক হোসেন মন্টির বাসার চাদর দিয়া শিমুর দেহ পেঁচিয়ে ৬ষ্ঠ তলার ছাদ থেকে নীচে নামিয়ে ওয়াসার টিনশেড ঘরে টিনের উপর ফেলে দেয়। মন্টির ঘর থেকে বালতি ও মগ আনিয়া তোতলা সুমন, আলম পানি দিয়ে রক্ত পরিস্কার করে। তখন ফজরের আজান দেয়। সাইদুল, মন্টিকে বাসা থেকে কয়েকদিন বাইরে থাকতে বলে এবং অন্য সবাইকে গা ঢাকা দিতে বলিয়া সাইদুল চলে যায়।
ডিবি’র ডিসি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর, পিপিএম এর নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জনাব খন্দকার নুরুন্নবী এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে মতিঝিল জোনাল টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার জনাব জুয়েল রানা এর নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয়।