দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ মার্চ: ৩৪ বছর ধরে চেক প্রজাতন্ত্রে বসবাস করছেন খ্যাতিমান বিজ্ঞান লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, মাইগ্রেশন এন্ড ইন্টিগ্রেশন কনসালটেন্ট নাদিরা মজুমদার। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারী ‘ইনভেস্টিগেটিভ’ স্টাফ রিপোর্টার তিনি। ১৯৮০-৮১ সালে সমগ্র বাংলাদেশ এক নামে জানতো-চিনতো প্রথিতযশা এই সাংবাদিককে। নাদিরা মজুমদারের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১১ মে ঢাকায়। স্বাধীনতার আগে-পরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীণ সময়ে কচিকাঁচার মেলার দাদা ভাইয়ের উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর এই জগতে আবির্ভাব। প্রখর মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তিতে অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতা তথা ‘ইনভেস্টিগেটিভ’ রিপোর্টিংয়ে পৌঁছে যান খ্যাতির শীর্ষে।
ইত্তেফাক পাবলিকেশন্সের সাড়াজাগানো প্রকাশনা ‘সাপ্তাহিক রোববার’-এর হয়ে নাদিরা মজুমদার ছিলেন ঐ সময়কার ‘সেলিব্রেটি’ সাংবাদিক। প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকান্ডের সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরীতে সর্বাগ্রে ছিলেন তিনি। ট্র্যাজেডির আলোচিত রিপোর্টগুলো ছিল তাঁরই করা। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সেই অভিশপ্ত কক্ষের রক্তাক্ত সব ছবি নাদিরা মজুমদারই সযত্নে তুলেছিলেন। প্রফেসর সালাম নোবেল বিজয়ের পর তাঁর ওপর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রথম আন্তঃনগর ট্রেন চালু হবার সময়কালে তাঁর করা প্রতিবেদনগুলো ব্যাপক সাড়া জাগায় পাঠক মহলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী নাদিরা মজুমদারই ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোন পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক ফিচার পাতা চালু করেন।
ভিনদেশী নাগরিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সুবাদে ১৯৮১ সালেই বাংলাদেশকে ‘গুডবাই’ জানাতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের এই সাহসী নারী সাংবাদিককে। নাদিরা মজুমদার চেক প্রজাতন্ত্রে পরিচিতি লাভ করেন পরিবর্তিত নামে আফতাব হালাদিকোভা (Aftab Hladikova) হিসেবে। চেক স্বামীর হাত ধরে প্রবাসীর খাতায় নাম লেখাবার পর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে যোগ দেন সরকারী চাকরীতে। মাইগ্রেশন এন্ড ইন্টিগ্রেশন চ্যাপ্টারে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে টানা এক দশক সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন নাদিরা মজুমদার। চেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এসাইলাম এন্ড মাইগ্রেশন পলিসি ডিপার্টমেন্টে ছিল তাঁর সরব পদচারনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পর টানা পাঁচ বছর ছিলেন চেক শ্রম মন্ত্রনালয়ে। মাইগ্রেশন ও ইন্টিগ্রেশন ইস্যুতে প্রাগে তাঁর বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সময়ে। দেশটির ঐতিহ্যবাহী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও কাজ করেছেন নাদিরা মজুমদার।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর)-এর প্রাগ অফিসে ‘এক্সটার্নাল কনসালটেন্ট’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন নাদিরা মজুমদার। পদার্থ বিজ্ঞান যাঁর রক্তে মিশে আছে সেই মানুষটির কলম কিন্তু থেমে থাকেনি প্রবাসের বর্ণিল ব্যস্ততার মাঝেও। আশির দশকের মাঝামাঝি ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক বিশেষ গ্রন্থ ‘কৃত্তিম উপগ্রহ’। প্রায় ৩০ বছরের ব্যবধানে সেই বাংলা একাডেমি থেকেই গত বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘নানা রঙের বিজ্ঞান’। আধুনিক বিজ্ঞানকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সহজবোধ্য ও সাবলীলভাবে তুলে ধরার মিশনে নাদিরা মজুমদার শুধু বড়দের জন্যই কাজ করেননি, শ্রম দিয়েছেন শিশুদের কল্যানেও।
স্বনামধন্য লেখক-সাংবাদিক-গবেষক নাদিরা মজুমদারের বিজ্ঞান বিষয়ক বই ‘এই আমাদের পৃথিবী’ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি হতে। ‘আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের কাহিনী’ শীর্ষক তাঁর আরেকটি প্রকাশনা ছিল ২০১৪ সালে শিশু একাডেমি থেকেই। এর মধ্যে ‘এই আমাদের পৃথিবী’ বইটির কপিরাইট কিনে তা দুই দফায় প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ‘ইউনিসেফ’। প্রাগে বসেই ঢাকার প্রথম সারির দৈনিকে এখনো নিয়মিত লিখে থাকেন নাদিরা মজুমদার। ইউরোপের ৩০টি দেশের বাংলাদেশীদের সম্মিলিত সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা) ২০১২ সালে এথেন্সে অনুষ্ঠিত তাদের গ্র্যান্ড কনভেনশনে বিশেষ এওয়ার্ডে ভূষিত করে এই মেধাবী বাংলাদেশীকে। মরনোত্তর নয়, জীবদ্দশাতেই বাংলা একাডেমি পুরষ্কার সহ একুশে পদকেও সম্মানিত হবেন নাদিরা মজুমদার – এমন প্রত্যাশাই আজ সবার।