mahbub_hossain_BCCNews24.com_

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৬ মার্চ: বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া একাধারে দলটির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং দেশি-বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন। সংলাপ প্রস্তাব ব্যর্থ হলে রাজপথেই সংকট সমাধান করতে চায় ২০ দল। এজন্য চলমান আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় ২০ দলীয় জোট। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করে।জোট নেতাদের দাবি, যেহেতু ক্ষমতাসীনরা সংলাপ সমঝোতার পথ বার বার প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। তাই তারা (সরকার) সংলাপ সমঝোতার পথে না আসলে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে চলমান সংকট নিরসন করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে তারা।

সূত্রটি জানায়, এই মুহূর্তে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন ছাড়া সামনে কোনো পথও খোলা নেই। কারণ গত বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করার পর নেতা-কর্মীদের ওপর আরও বেশি জুলুম-অত্যাচার নেমে আসে। গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয় অনেককে। এমনিতে গুমও হয়েছেন অনেকে। তাই সার্বিক বিবেচনায় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি এবার প্রত্যাহার করবেন না বলেও জানা গেছে।তবে সরকার কেবল মাত্র অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়ে সংলাপ-সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করলেই ২০ দল কিছুটা ছাড় দিতে রাজি আছে। আর এখন সরকার হার্ডলাইনে থাকায় বিএনপি জোটের নরম হওয়ার সুযোগও নেই।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমান  বলেন, বিএনপি সব সময়ই সংলাপ-সমঝোতার পক্ষে আহ্বান জানিয়ে আসছে। অথচ ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে বিরোধী দল-মতের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে বিএনপির আন্দোলন করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

সেক্ষেত্রে সরকার সংলাপের পথে না আসলে বিএনপি ও ২০ দলের শরিকরা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই সংকট সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে মনে করেন তিনি।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিএনপি কূটনীতিক মহল নয়, সব সময়ই রাজপথের আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট চলমান সংকট সমাধানে রাজপথের আন্দোলনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যার প্রমাণ সম্প্রতি বেগম জিয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যৌক্তিক পরিণতির দিকে না পৌঁছা পর্যন্ত জনগণের চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এদিকে বিএনপির আরেকটি সূত্র জানায়- হঠাৎ করে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করা হলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা নতুন করে বিপদের মুখোমুখি হবেন। টানা অবরোধে ক্লান্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিছুটা সুবিধা নিতে পারে। মাঠের অনেক নেতা-কর্মীর গ্রেফতার-হয়রানির পাশাপাশি জীবন নাশের আশঙ্কাও রয়েছে।

এসব বিবেচনায় অবরোধের পাশাপাশি সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত বিএনপি জোটের। সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও বেগম খালেদা জিয়া সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল অস্কার ফার্ণান্দেজ তারানকো, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সমন্বয়ে ১৬ টি দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের চলমান সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।এসব বিবেচনায় রেখে সরকার দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে ২০ দল।

এদিকে, আতঙ্কে উধাও বিএনপিকারাগার ও আত্মগোপনে পতিত বিএনপি। চলমান আন্দোলনে সরকারের খড়গ নেমে আসার পর থেকেই অনেক নেতাকর্মী কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে হয় কারাবন্দি না-হয় আত্মগোপনে। পলাতক। গ্রেফতার আতঙ্ক গোটা বিএনপিকে গ্রাস করায় যেসব নেতাকর্মী বাইরে তারাও উধাও। তাদের ক্রিকেট দলের বিজয় উৎসব থেকে জাতীয় বিভিন্ন দিবসের দলীয় কর্মসূচি থেকে মাঠের কর্মসূচিতেও মিলছে না। গণমিছিল ডেকেও সেøাগান তোলা বা তা করার নেতাকর্মী জোটেনি গ্রেফতারের ভয়ে।

গ্রেফতারের বাইরেও রয়েছে গুম, বন্দুকযুদ্ধ আতঙ্ক। এর মধ্যে একে একে নিভেছে দেউটির মতো মুখপাত্রের উইকেটও পড়ছে। মির্জা ফখরুলের পর দলের মুখপাত্র ছিলেন রিজভি আহমেদ। একে এক দুজন জেলে যাওয়ার পর মুখপাত্র হয়ে আসা সালাউদ্দিন আহমেদ উধাও। এখন আত্মগোপনে কর্মসূচি দিচ্ছেন বরকত উল¬াহ বুলু।

নেতাকর্মীরা জানান, দলের নির্বাহী কমিটি ৩৮৬ সদস্যবিশিষ্ট, এর মধ্যে ১২১ জন কর্মকর্তা ও ২৬৫ জন সদস্য রয়েছেন। এছাড়া সারাদেশে ৭৬টি সাংগঠনিক কমিটি এবং অঙ্গ সংগঠন মিলে কয়েক হাজার নেতা রয়েছেন বিএনপিতে। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারি থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করার পর হাতেগোনা কয়েক নেতা আন্দোলনকে গতিশীল করতে কাজ করছেন। আর অন্যদের বিষয়ে কর্মীরা কিছুই জানেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

তাদের মতে, এসব কমিটির অনেক সদস্য মৃত্যুবরণ, গুম ও দল পরিবর্তন করায় অনেক পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া কমিটির এ বিশাল বহরের অনেক সদস্যই রয়েছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। রাজনীতি কিংবা দলে তাদের ভূমিকা কি তা যেমন নেতাকর্মীরা জানেন না, তেমনি তাদের জনগণও চেনে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা দেশ-বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন অথবা কোনো বিশেষ দায়িত্ব কোথাও নেই তারা। দলের হাইকমান্ড থেকে বারবার এসব নেতাকে সতর্ক করা হলেও এবারো কোনো পরিবর্তন হয়নি। সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুরো সময় নিয়মিত অনুপস্থিত রয়েছেন রাজপথ থেকে।

এর মধ্যে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে সাবেক মহাসচিব অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করেছেন। ড. আর এ গনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুর্নীতির মামলায় কারান্তরীণ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর রাজনীতি থেকে অনেকটা দূওে রয়েছেন। তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে এক অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তরিকুল ইসলাম ও এমকে আনোয়ার বিভিন্ন মামলার কারণে অনেকটা আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে এ অবস্থায়ও কাজ করছেন তারা। তরিকুল ইসলাম যশোর জেলাসহ বৃহত্তর খুলনা জেলায় আন্দোলনের জন্য ওই এলাকায় অবস্থান করছেন।

লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান তার নিজ বাসায় অবস্থান করলেও সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত নিজেকে উপস্থাপন করছেন। অনেক সময় দলের ভোকাল হিসেবেও কাজ করতে হচ্ছে তাকে। আবদুল মঈন খান আন্তর্জাতিক মহল নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন। এম শামছুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধের মামলায় কারান্তরীণ, বেগম সারওয়ারী রহমানও দলের জন্য সময় দিতে পারছেন না শারীরিক অসুস্থতার কারণে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ্ সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, নজরুল ইসলাম খান আন্দোলনের শুরুতে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকের আগে গুলশান কার্যালয়ে আসেন। কিন্তু গ্রেফতারের আশঙ্কায় তিনি আর কার্যালয় থেকে বের হননি। স্থায়ী কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস রয়েছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। এবারো মহানগর বিএনপি কার্যত কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বলে তাকে নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে।

১৬ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে একজন মৃত, একজন বহিষ্কার, আরেকজন দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে। এছাড়া আবদুল¬াহ আল নোমান আত্মগোপনে থেকেও চট্টগ্রামভিত্তিক কাজ করছেন, সেলিমা রহমান গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন ৩ জানুয়ারি থেকে, শমশের মবিন চৌধুরী (আটক), মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দলের হয়ে মাঝে মাঝেই সরব ভূমিকা পালন করছেন, সাদেক হোসেন খোকা যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন থাকার পরও বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করছেন। এছাড়া বাকিদের সবাই প্রায় নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।

৭ যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে দু’জনই কারাগারে আটক রয়েছেন। বাকিদের মধ্যে আমানউল¬াহ আমান ব্যতীত সবাই যে যার অবস্থানে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। গত ৩ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করার পর প্রকাশ্যে তার ছেলের বিয়ের ধুমধাম অনুষ্ঠান করেন। এরপর তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি।এছাড়া ২৬৫ নির্বাহী কমিটির সদস্যের মধ্যে বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়। উপরন্তু অনেক নেতা সরকার-দল ও নেতাকর্মীদের কাছে নিরাপদ থাকতে এবং বিতর্ক এড়াতে স্বেচ্ছায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এদের প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হওয়ায় এ সন্দেহ কাজ করছে নেতাকর্মীদের মাঝে।

এসব বিষয়ে নেতাকর্মীরা জানান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক-তৃতীয়াংশ নেতা আন্দোলন ও রাজপথে সরব ভূমিকা পালন করলে এর গতি-প্রকৃতি অনেক আগেই পরিবর্তন সম্ভব হতো। তারা আরো অভিযোগ করে বলেন, এসব নেতার মধ্যে অনেকে সরকারের সঙ্গে আপসরফার মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য তারা একদিকে যেমন রাজপথে নামেন না, তেমনি কর্মীদেরও নামতে নিরুৎসাহিত করছেন, এমনকি হুমকিও দিয়ে আসছেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার নেতারা অন্যতম।

তবে বিষয়টির সঙ্গে একমতপোষণ করছেন না দলের নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, এবারের আন্দোলনে কম- বেশি সবাই অংশগ্রহণ করছেন। যে যার অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলেই বিগত আন্দোলনের পারফরম্যান্স নিয়ে দলের হাইকমান্ড সন্তুষ্ট রয়েছে। এছাড়া দলের নীতিনির্ধারণীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলন কন্টিনিউ করার জন্য যত সম্ভব গ্রেফতার এড়িয়ে কৌশলের আশ্রয় নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। আর এ কারণেই দুই মাসের বেশি আন্দোলনে সরকার গণগ্রেফতার অভিযান চালিয়েও আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।

এদিকে দলের অপর একটি সূত্র জানায়, দলের একটি দায়িত্বশীল অংশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে হাইকমান্ড অবগত রয়েছেন। ইতিমধ্যে তাদের একটি তালিকাও তৈরি করে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কাছে দেয়া হয়েছে। এর পর পরই তাদের বিভিন্ন উপায়ে সতর্ক করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।এদিকে দলীয় সূত্র জানায়, আন্দোলন শুরু করার পর থেকে সরকারের গ্রেফতার অভিযানে ইতিমধ্যে দলের অনেক সিনিয়র নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, দলের বেশিরভাগ নেতা নিক্রিয় এ কথা সঠিক নয়। তবে একটি অংশ রাজপথে না থেকে দলের জন্য কাজ করছেন। আর এসব বিষয়ে দলের হাইকমান্ড ওয়াকিবহাল আছেন বলেও তিনি উলে¬খ করেন।