দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৪ মার্চ: ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধে এ পর্যন্ত শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। প্রায় ১২শ গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে আপসহীন মনোভাবের কারণে বাংলাদেশে চরম রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বান জানানো হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী অবরোধ ও হরতালের কারণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। কমেছে রফতানি। তৈরি পোশাক খাতে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। বিদেশী ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তারা শান্তিপূর্ণ অন্য দেশগুলো থেকে পোশাক তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কাতারভিত্তিক আলজাজিরার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।শুক্রবার আলজাজিরার অনলাইন ভার্সনে তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ব্লাডি ব্লকেড ক্রিপলস বাংলাদেশ ইকোনমি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের চেয়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিতে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোট গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়। এ নিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি আহ্বান করা হয়। এর সঙ্গে থেমে থেমে চলে হরতাল। এ অবস্থায় অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।এদিকে, নিউইয়র্কভিত্তিক সাপ্তাহিক আজকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’। কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা না ছাড়ার সিদ্ধান্তে পুরোপুরি অনড় ক্ষমতাসীনরা। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা তো বটেই, এমনকি ১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা, সরকার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো মাত্রই ভয়ঙ্কর এক প্রতিশোধের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবেন তারা। অতএব যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের প্রধান এজেন্ডা। আর সে কারণেই আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের তরফ থেকে অব্যাহত তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও সরকার প্রসঙ্গটিকে পুরোপুরিই অগ্রাহ্য করে চলেছে। একইসঙ্গে সরকার বিরোধী পক্ষের তৎপরতা দমনে কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।
অপরদিকে, আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে এলে অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে বিরোধী জোটকে। সুতরাং চলমান কর্মসূচিতে ক্ষান্তি দেওয়ার কোনোই সুযোগ নেই বলে মনে করছেন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকরাও। এ কারণে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা সত্ত্বেও টানা অবরোধ এবং নিয়মিত হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধী জোট। যদিও এই জোটের বড় দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুত সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বলে খবর রয়েছে। অবশ্য অভ্যন্তরীণ এই বিরোধ মিমাংসায় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। নিজেদের মধ্যকার এমন টানাপোড়েন সত্ত্বেও বিএনপি-জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা লাগাতার কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত। এ অবস্থায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলম্বিত রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান কিভাবে হতে পারে, সে সম্পর্কে কেউই যেন কিছু আন্দাজ করতে পারছেন না। যদিও বিশিষ্টজন তথা নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সংকট নিরসনে আলাপ-আলোচনাকেই একমাত্র পথ হিসাবে বিবেচনা করছেন।
ঢাকায় ক্ষমতাসীন মহলের বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বিরোধী জোটের টানা আন্দোলনের মুখে এই পর্যায়ে ক্ষমতা থেকে সরে এলে এখনকার ক্ষমতাসীনদের পরিণতি কি হতে পারে, তা নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের নানা ধরনের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ। এসব আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণে প্রায় সকলেই একমত হয়েছেন যে, বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে এখন ক্ষমতা ছেড়ে দিলে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বিভিন্ন পদ-পদবীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রশাসনের চিহ্নিত সদস্যরা এবং ১৪ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিশ্চিতভাবেই বড় রকমের প্রতিশোধ-সন্ত্রাসের মুখে পড়বেন। দেশি-বিদেশি যেসব মহল এখন আলোচনা বা সংলাপের জন্য তাগিদ দিচ্ছেন, তারা কেউই সম্ভাব্য সেই কঠিন পরিস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় সরকারের নীতি-নির্ধারক ও শুভাকাঙ্খীরা কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা না ছাড়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণের পক্ষে একাত্ম। এই প্রেক্ষিতে বিরোধী মহলের সব ধরনের তৎপরতা মোকাবেলায় প্রয়োজনে ‘জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সংলাপ বা সমঝোতার ব্যাপারে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশিদের সব ধরনের তাগিদ ও আহ্বানকে নিরবে এড়িয়ে চলার ব্যাপারেও সরকারের নীতি-নির্ধরাকরা একমত হয়েছেন। এছাড়া দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজ বা বিশিষ্টজন পরিচয়ে যারা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার বিষয়ে সোচ্চার হতে চান তাদের অতীতের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-কে সামনে তুলে এনে সেগুলো গণমাধ্যমে প্রচারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বিরোধী জোটের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আন্দোলনের এ পর্যায়ে ক্ষান্তি দেওয়া বা সাময়িকভাবে কর্মসূচি স্থগিত রাখার বিষয়টি এমনকি তারা চিন্তাও করছেন না। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা জানিয়েছেন, বিরোধী দল এখন যে আন্দোলনে রয়েছে তা কেবল ২০ দলীয় জোটের ক্ষমতায় যাওয়া বা ব্যক্তি বিশেষের মন্ত্রী-এমপি হওয়ার আন্দোলন নয়। এমনকি শুধুমাত্র বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্বের লড়াইও এটি নয়। বাস্তবে এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তথা রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা রক্ষার লড়াই। তিনি বলেন, বর্তমান দখলবাজ সরকারের সঙ্গে অতীতের কোনো সরকারকেই মিলানো যাবে না। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য এই সরকার ‘যত খুশি মানুষ মারা’র নীতি গ্রহণ করেছে এবং নিজেদের এমন অমানবিক অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাইতে দেশের সকল গণমাধ্যমকে বাধ্য করা হচ্ছে। এই রকম দস্যু-শাসন মেনে নেওয়ার জন্য তো এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একটি ভূয়া নির্বাচনের আবরণে রাষ্ট্রটিকে ডাকাতি করে নিয়েছে। তাদের এই ডাকাতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ক্ষান্তি দেওয়া হলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন হয়ে পড়বে। সুতরাং এই আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত চট্টগ্রামের এক সিনিয়র নেতা বলেন, বাংলাদেশে অতীতে কোনো আন্দোলনেই এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে জীবন দিতে হয়নি, এত মানুষকে জেলে যেতে হয়নি। সরকারের সর্বাত্মক মারমুখী অবস্থানের মধ্যেও বিরোধীজোট টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। এত দীর্ঘসময়ের একটি আন্দোলন কখনও স্তিমিত হবে, কখনো আবার জোরালো হবে। কিন্তু যেহেতু এই আন্দোলনের প্রতি দেশের ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষের সমর্থন রয়েছে (তাঁর দাবি মতে) সে কারণে বর্তমান সরকারের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবেই। তিনি জানান, শরিক দল জামায়াতের সঙ্গে কিছু ইস্যুতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল এটা ঠিক, তবে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে সেই সমস্যা ইতিমধ্যেই মিটে গেছে। সুতরাং চলতি সপ্তাহ থেকেই আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে দুই পক্ষের এমন পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অবস্থানের প্রেক্ষিতে অচলাবস্থা নিরসনের উপায় সম্পর্কে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যে যাই বলুক, বাস্তবে আলোচনা ছাড়া তো সমাধানের কোনো পথ নেই। আমরা বলছি, বিদেশিরাও বলছে। যেভাবেই হোক না কেন, কোনো না কোনোভাবে আলোচনা শুরু হতেই হবে। সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবেও এটা শুরু হতে পারে। কিন্তু আলোচনার পথ এড়িয়ে বর্তমান সংকট থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাবে না। আর বিবদমান পক্ষগুলো সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে সবাইকেই কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।টেলিফোন আলাপে প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সংকট বা অচলাবস্থা নিরসনে আলোচনা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। বিবদমান পক্ষগুলোর সবাইকেই এদেশে থাকতে হবে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের অস্তিত্বকে মেনে নিতে হবে। তা না হলে এদেশ বসবাসের যোগ্য থাকবে না। তিনি বলেন, দেশে যে অচলাবস্থা চলছে এটা সমাধানের অযোগ্য কোনো সংকট নয়। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এ সংকটের অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে, আলোচনা হবে। এ জন্য হয়তো সময় লাগবে। যারা এখন আলোচনায় বসতে সম্পূণরুপে নারাজ, তারাও ভাল করেই জানেন যে, আলোচনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।