দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৪ মার্চ: লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় প্রধান সন্দেহভাজন আসামি শাফিউর রহমান ফারাবীকে এবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তথ্য প্রযুক্তি আইনের একটি মামলায় ৫ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। এরআগে অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল।ওই রিমান্ড শেষে শনিবার ফারাবীকে আদালতে হাজির করে রমনা থানার তথ্য প্রযুক্তি আইনের অন্য একটি মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানান ডিবির পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান। শুনানি শেষে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।
শনিবার সকাল ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান ফারাবীর বিরুদ্ধে এ মামলাটি দায়ের করেন।মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজামসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ব্লগারকে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। রমনা থানার উপ-পরিদর্শক নরেন্দ্র কুমার সরকার বলেন, তথ্য ও প্রযুক্তি আইন-২০১৩ (সংশোধিত) আইনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।গত ২৬ ফেব্র“য়ারি রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। ওই হামলায় আহত হন অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
এ হত্যাকাণ্ডের পরদিন নিহত অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় শাহাবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তিনি কারো নাম উল্লেখ না করলেও সাংবাদিকদের বলেন, ধর্মীয় উগ্রবাদীরাই অভিজিতকে হত্যা করেছে।অভিজিৎ-বন্যা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দৈত নাগরিক হওয়ায় এ হত্যা মামলার তদন্তে সহযোগিতার আগ্রহ দেখা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই। এফবিআইয়ের এ আগ্রহে বাংলাদেশ ইতিবাচক সাড়া দিলে সংস্থাটির চার সদস্য তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে আদালতের অনুমতিক্রমে মামলায় বেশ কিছু আলামত তারা পরীক্ষা করে দেখছেন।২৬ ফেব্র“য়ারি অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ২ মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে র্যাবের হাতে আটক হন ফারাবী। ফেসবুকে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
ওইদিন সকালে আটকের পর বিকেলে ফারাবীকে ডিবি পুলিশের হাতে তুলে দেয় র্যাব। তার আগে উত্তরায় র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় ফারাবী শফিউর রহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম শাখা) মুফতি মাহমুদ বলেছিলেন, আটকের পর ফারাবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে জানিয়েছে, এক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অভিজিতকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল সে। হত্যাকাণ্ডে সে সরাসরি জড়িত কিনা সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে অভিজিৎ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
তিনি আরো বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে অভিজিতের সঙ্গে ফারাবীর পরিচয়। প্রথম দিকে অভিজিতের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল। ভিন্ন মতাদর্শের কারণে পরবর্তীতে অভিজিতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় তার। তবে অভিজিতের ব্লগের লেখাগুলো তিনি নিয়মিত পড়তেন। অভিজিৎ খুন হওয়ার পর পর ফারাবী তার ফেসবুক ও ব্লগে বিভিন্ন কমেন্ট ও ছবি শেয়ারও করেছে। এসব থেকে ধারণা করা হচ্ছে হত্যাকাণ্ডে সে জড়িত থাকতে পারে। এজন্য সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছে।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারাবী র্যাবকে আরো জানিয়েছেন, মান্নান রাহি নামে আরেক ব্লগারকে তিনি বলেছিলেন অভিজিতকে এখন হত্যা করা সম্ভব হবে না। সে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা যেতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তিন-চার বছর ধরে ফারাবী ব্লগার হিসেবে ইসলামী চিন্তা-চেতনা নিয়ে লেখালেখি করে জনপ্রিয়তা পান। নিজের মতাদর্শের বিপরীতে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের বিভিন্ন ব্লগে বিরোধিতা করতে থাকেন তিনি। এ নিয়ে তার সঙ্গে রাজীব হায়দার (থাবা বাবা), আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, তসলিমা নাসরিন, দাড়ি-পাল্লা ধমাধম, দিগম্বর-পয়গম্বর, সানতুনু মহাপাত্র, অগ্নিবীনা, মশিউর রহমান (আল্লামা শয়তান), সানতুনু আদিম, প্যানগ্যান দেবতা ও হিন্দু যোদ্ধা নামক ব্লগারদের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ফেইসবুকে উগ্রপন্থি বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার এবং লেখক-সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সকালে রমনা থানায় ফারাবীর বিরুদ্ধে এই মামলা হয়।
অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক ফজলুর রহমান এই মামলা করেন বলে রমনা থানার এসআই নগেন্দ্র কুমার দাশ জানান।নতুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআ্ই ওহিদুজ্জামান দুপুরে ফারাবীকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের হেফাজত চান। শুনানি শেষে বিচারক তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।এ সময় ফারাবীর পক্ষে কোনো আইনজীবী এজলাসে ছিলেন না। তার জামিন চেয়েও কোনো আবেদন হয়নি।এর আগে অভিজিৎ হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ৩ মার্চ ফারাবীকে ১০ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
গত ২৬ ফেব্র“য়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির উত্তর পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক অভিজিৎ রায়কে। ফেইসবুকে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ফারাবী। অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে তার নাম নতুন করে আলোচনায় আসে।উগ্রবাদীদের পক্ষে বিভিন্ন সময় কার্যক্রম পরিচালনাকারী ফারাবী বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট রকমারি ডটকম’ থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরাতেও হুমকি দিয়েছিলেন এর আগে।২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারিতে শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকে হত্যার হুমকি দিয়েও ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে ফারাবী।
ওইবছর ২৪ ফেব্র“য়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেইট এলাকা থেকে পুলিশ ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে। ফেইসবুক ব্যবহার করে ইমামকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে জুন মাসে ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগও গঠন করে।কিন্তু হাই কোর্টের জামিনে ২০১৩ সালের ২১ অগাস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যান ফারাবী। আর মুক্তি পেয়েই নাস্তিকদের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে তিনি ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন, যাতে বলা হয় আমার দৃষ্টিতে নাস্তিকরা হচ্ছে পোকামাকড় আর পোকামাকড়দের মরে যাওয়াই ভাল।ফারাবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হলেও ২০১০ সালে হিজবুত তাহরীরে সক্রিয় হয়ে লেখাপড়া শেষ করেনি। নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগে একমাস জেলও খাটতে হয়েছিল তাকে।