দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১১ মার্চ: নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপের উদ্যোগ নেয়ার দাবিতে বিএনপির লাগাতার অবরোধ ও ধারাবাহিক বিরতিতে হরতালের বুধবার ৬৫ দিন পেরিয়ে গেল। এ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছে কমপক্ষে ১১৮ জন। আর ১ হাজার ৩১৭টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত।এই সঙ্কট নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতাও লক্ষ্যনীয়। বিএনপি চেষ্টা করছে এই তৎপরতাকে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে।কিন্তু এতে কতোটা সফল হলো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট? সরকার কিন্তু তাদের অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েনি। মাঝে সংলাপের দরজা খোলা- বলে আশার বাণী শোনান ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরা। কিন্তু পরক্ষণেই শর্তারোপ করেন। বিএনপিকে পরোক্ষভাবে জঙ্গিবাদী দল আখ্যা দিয়ে সংলাপের জন্য সহিংসতা বর্জনের পূর্ব শর্ত জুড়ে দিচ্ছে।রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বিঘিœত করে সরকারকে সংলাপের উদ্যোগী হতে বাধ্য করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এ কারণেই টানা কর্মসূচি। মাঝে মাঝে তারা নমনীয় ভাবও দেখাচ্ছে।
কিন্তু সরকার তাতে গা করছে না। বল প্রয়োগের নীতিকেই গ্রহণ করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, খুনি, জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়। আর তার কথারই প্রতিধ্বনি করছেন দলীয় নেতা থেকে মন্ত্রী-এমপি সবাই।সংলাপে সরকারের অনীহার কারণে সংকটের সুরাহায় নির্বাচনকালীন সরকারের নতুন নতুন ফর্মুলা আসতে শুরু করেছে। বিদেশিরা যেমন এসব ফর্মুলা দিচ্ছেন, তেমনি দেশের রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও এসব ফর্মুলা হাজির করছেন। কেউ মিডিয়ায় লিখে কেউ সেমিনার সিম্পোজিয়ামে কেউবা লিখিত আকারে ফর্মুলাগুলো তুলে ধরছেন। সম্প্রতি বিদেশি কূটনীতিকরা তিনটি ফর্মুলা শীর্ষ দুই দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।দেশি-বিদেশি ফর্মুলাদাতাদের সবার উদ্দেশ্য জনগণের ভোটের অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সংকট নিরসনে নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী মনে করেন, বিদেশিরা হয়তো প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যে প্রতিশ্র“তিতে আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছিলেন বিএনপিকে; সেই প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের জন্যই ফর্মুলা দিয়েছেন। হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ফর্মূলা আসছে; কিন্তু সংলাপে বসলে হাজারো ফর্মুলা হাজির হতো।
রাজনৈতিক সংকট সুরাহায় দেশ-বিদেশ থেকে এতদিন দুই দলের মধ্যে ছিল সংলাপের চাপ। দেশের বিশিষ্টজন, পেশাজীবী, সিনিয়র নাগরিক, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জাতিসংঘ, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার পরামর্শ দেন। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফোন করেও দুই শীর্ষ নেত্রীকে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সুরাহার পরামর্শ দেন। কিন্তু দুই মাস ধরে টানা অবরোধ ও হরতালে দেশে বিপর্যস্তকর অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় এখন অনেকেই সংকটের স্থায়ী সমাধানে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে ফর্মুলা দিচ্ছেন। দেশি-বিদেশি এসব ফর্মুলা সংলাপের দাবিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিদেশি কূটনীতিকরা তিনটি বিকল্প ফর্মুলা উপস্থাপন করেছেন। প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কূটনীতিকরা সক্রিয়ভাবে এগুচ্ছেন বলে জানা গেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে এর কোনোটির পক্ষেই সাড়া নেই। বিদেশিদের প্রস্তাবিত এই জাতীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের আয়োজন করার কথা বলা হচ্ছে। এ সরকারের প্রধান করা হবে প্রেসিডেন্টকে। তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জানা গেছে,১৭ দেশের কূটনীতিকরা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে সংকটের সুরাহায় তিনটি ফর্মুলা দিয়েছেন। ফমুর্লাগুলো হলো- (এক) শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে সবগুলো দলের সমন্বয়ে অন্তবর্তীকালীন এক জাতীয় সরকারের অধীন নির্বাচন। (দুই) রাষ্ট্রের অভিভাবক প্রেসিডেন্টের অধীনে সবগুলো দলের সমন্বয়ে অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। (তিন) আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা হচ্ছে তা বন্ধ করে সংলাপ শুরুর পরিবেশ তৈরির নিশ্চয়তা। বেগম জিয়া প্রথম ফর্মুলার (প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে) ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখালেও অন্যান্য ফর্মুলার ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। এই ফর্মুলা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে দেয়া হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি ফর্মুলা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা কমিয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সঙ্গে ভারসাম্য এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অধিক ক্ষমতায়ন করে নির্বাচিত এমপিদের সমন্বয়ে অন্তবর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের ফর্মুলা দেন।
একটি জাতীয় দৈনিকে তিনি এই ফর্মূলা তুলে ধরেন। অতঃপর তিনি দেশের সিনিয়র নাগরিক হিসেবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সংকট সমাধনের জন্য মান কি মুনকে চিঠি লেখেন। কিছুদিন আগে সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান দেশের প্রতিশ্র“তিশীল তরুণ এবং দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের মাধ্যমেও নির্বাচন করার একটি ফর্মুলা দেন কয়েক মাস আগে। নাইমুল ইসলাম খানের সেই ফর্মুলা প্রায়ই টকশোতে তুলে ধরেন সাবেক আমলা ড. সাদত’ হুসাইন। সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রেসিডেন্টকে সংকট সুরাহার জন্য উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়ে একটি নির্বাচনী ফর্মুলা তুলে ধরেন। তার ফর্মুলায় রাজনৈতিক সংকটের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের কথা বলা হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনও কিছুদিন আগে সংকট নিরসনের ফর্মুলা দিয়েছিলেন। একজন জাতীয় সংলাপ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার খোলনলচে বদলে ফেলার ফর্মুলা দেন : অন্যজন রাজনীতি পরিবর্তনের ফর্মুলার মাধ্যমে সুরাহার প্রস্তাব দেন। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, বিএনপির আলোচিত ও বিতর্কিত বহিষ্কৃৃত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও সংকট সুরাহায় ভোটের সময়ের সরকারের ফর্মুলা তুলে ধরেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে সংকট সমধানের ফর্মুলা তুলে ধরেন। সংকট সুরাহায় নতুন নির্বাচন জনগণ চায় কিনা তা জানতে গণভোট আয়োজনের দাবি জানান। তার দাবি গণভোট ফর্মুলা’ হলো-গণভোটে যদি জনগণ মধ্যবর্তী নির্বাচন চায় তাহলে নির্বাচন দিতে হবে। আর যদি না চায় তাহলে বর্তমান সরকারকে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী একাধিকবার সবদলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের লক্ষ্যে ফর্মুলা দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের দেয়া ফর্মুলার সমর্থন জানিয়ে আরো ৩টি শর্তজুড়ে দিয়েছেন। ফর্মুলা আকারে বি চৌধুরীর শর্তগুলো হলো-প্রথমত, যেহেতু দশম জাতীয় সংসদ অবৈধ তাই নবম সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়েই প্রেসিডেন্টের অধীনে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গঠিত ওই জাতীয় সরকারে যারা থাকবেন তারা আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। তৃতীয়ত, জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পর তাদের প্রধান কাজ হবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা; আগামী নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করা। একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, দেখলাম প্রেসিডেন্টের অধীনে জাতীয় সরকারের একটি প্রস্তাব বিদেশিরা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো (খালেদা জিয়া) এ প্রস্তাবে সায় দিয়েছে। আর এ প্রস্তাব এখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আটকে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সরকারকে গণতান্ত্রিক করতে হলে নির্বাচিত এমপিদের সমন্বয়ে করতে হবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধ না। তাই আগের নির্বাচিত সরকারের এমপিদের সমন্বয়ে এ সরকার গঠন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, অতীতে অনেক ফর্মুলা দেয়া হলেও ১৭ কূটনীতিক বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর ফর্মুলা দেয়ার হিড়িক পড়ে। অন্যদিকে সরকারের মধ্যে আতঙ্কভাব পরিলক্ষিত হয়। মনে হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি হঠাৎ আন্দোলন থেকে সরে আসা এবং পরবর্তীতে বেগম জিয়ার বক্তব্যে মনে হয় বিদেশিরাই বিএনপিকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল নয়া নির্বাচনের। সে জন্য বিদেশিরা এখন সরকারের অনিচ্ছা জেনেও পতাকা ছাড়াই একসঙ্গে বেগম জিয়ার সঙ্গে দুই ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। তারা সম্ভবত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দুইপক্ষের কাছে প্রতিশ্র“তি নিয়েছিলেন যে, এক/দেড় বছর পর নির্বাচন দিতে হবে। সে জন্য তারা নয়া নির্বাচনের ব্যাপারে দায়বদ্ধ। মিডিয়ায় দেখলাম, জাতিসংঘ বলে দিয়েছে ১৫ জুনের মধ্যে চলমান সংকটের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা না হলে তারা নিজেদের উদ্যোগে সংকটের সমাধান করবেন। সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হায়দার আকবর খান রনো ইনকিলাবকে বলেন, যে কেউ ফর্মুলা দিতেই পারেন। আমরা চাই সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সুরাহা। শুধু দুই দল নয় চিন্তাশীল মানুষ, অন্যান্য দল, পেশাজীবী এবং বিশিষ্টজনরা শর্ত ছাড়াই সংলাপে বসলে প্রস্তাব-পাল্টাপ্রস্তাব এবং বিতর্কে অনেক ফর্মুলা আসবে। সংকটের সমাধান প্রয়োজন।
এদিকে, সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সরকার সমঝোতার পথ সৃষ্টি করলেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট তাদের চলমান অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফ্টন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান।সংলাপে বিএনপি কী নিয়ে কথা বলবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়।একই বিষয়ে সেলিমা রহমান বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষিত সাত দফা দাবির উপর সংলাপ হতে পারে। এছাড়া ওই সংলাপে নতুন কিছু দাবিও যুক্ত হতে পারে। তবে এখনই বলা যাচ্ছে না পরবর্তী দাবিগুলো কী হবে। যখন সরকার সংলাপে বসতে রাজি হবে তখনই বলা যাবে।চলমান সহিংসতার সমাধানে সরকারকেই প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন সেলিমা রহমান।
উল্লেখ্য, গত ৩১ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারের কাছে সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। খালেদা জিয়ার ঘোষিত সাত দফা হচ্ছে-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনী আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ভোটার তালিকার ত্র“টি-বিচ্যুতি দূর করা, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করা, নির্বাচনের উপযোগী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারিখ ঘোষণার পরপরই বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা, নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত সদস্যদের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার এবং কর্তব্য পালন থেকে বিরত রাখা, সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেয়া, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা এবং বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া সব সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দেয়াসহ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ আটক সব সাংবাদিককে মুক্তি দেয়া। বিএনপি নেতৃত্বধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধ ও হরতালের বিকল্প হিসেবে নতুন কর্মসূচি আসছে। নতুন এই কর্মসূচি জনগণকে জানাতে আগামী সপ্তাহে যে কেনো সময় সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে যে কোনো দিন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করবেন। চলমান আন্দোলনে নেতাকর্মীদের রাজপথে নামার আহ্বান জানাবেন তিনি।এছাড়া, আন্দোলনে যেসব নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনদের সহযোগিতার আশ্বাস দেবেন বলেও জানা গেছে।বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বাংলামেইলকে বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমি কিছুই জানি না। তবে ম্যাডাম সংবাদ সম্মেলন করলেও করতে পারেন। সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।গণমাধ্যমকর্মী এবং সরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের তীক্ষ্ণ নজর এখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিক। গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে বাদাম, মোয়া, পাঁপড় বিক্রেতাদের কামায় বেড়েছে। তার ৬ নম্বর বাড়ির সামনে বসে অলসরা তাস খেলে সময় কাটায়।আর খালেদা জিয়া মাত্র দুইটি কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাঝে মধ্যে অনেকেই বলাবলি করে- খালেদা জিয়া কেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির মতো কার্যালয়ের মধ্য থেকে নেতাকর্মী এবং জনগণের উদ্দেশে কেন কথা বলেন না। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তো ভূতুড়ে অবস্থা। খালেদা জিয়ার ৭৯ সড়কের বাসভবন ফিরোজায় এখন ঘুঘু আর চড়ুই পাখির আবাস। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ আনা হলে কার্যালয়ে নিচে শোক বিহ্বল খালেদা জিয়াকে দেখা গেছে। সেই শেষ, এরপর আর গায়ে রোদ মাখেননি তিনি।
গত দুই মাসে খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে বেশ কয়েকদিন একাধিক পাগলের উপস্থিতি দেখা গেছে। এদের মধ্যে একজন খালেদাকে হত্যার জন্য পুলিশের বাধা উপেক্ষা প্রবেশের চেষ্টা করেছে। আর দেশি-বিদেশি বিশিষ্টদের আনাগোনা তো রয়েছেই। প্রায়ই আসছেন কূটনীতিকরাও।এদিকে জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীরা রাজপথের বাইরে আত্মগোপনে থাকছে। কিন্তু তারপরও কর্মসূচি চলাকালে ব্যাপক সহিংসতা হচ্ছে। নাশকতার দায় সরকার বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ওপর দিচ্ছে। তাদের নামে মামলা হচ্ছে, অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে। নিঁখোজ রয়েছে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে অনেকে। ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপরদিকে বিএনপি জোটের কিছু নেতা দেশে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।
সরকারের দমন নীতি ছাড়াও প্রতি পদে পদে রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হচ্ছে বিএনপি। বিএনপির সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং বহিষ্কৃত নেতারা সক্রিয় হয়েছেন, পাশাপাশি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পদত্যাগ চেয়ে ‘আসল বিএনপি এক দাবিদারের আবির্ভাব ঘটেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে।দাবি আদায়ে কার্যত এই সরকার বিরোধী জোট অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন পার্টি বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর ফোনকল নিয়ে ধোঁয়াশা এবং যুক্তরাজ্যের কয়েকজন সদস্যের ভুয়া বিবৃতিতে বিএনপি জোটকে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে।গত ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা নাটকীয়ভাবে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক করেছে। গতবার জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বৈঠক নিয়ে বিএনপি যেমন লুকোচুরি করছিল এবার তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কর্মীদের ধারণা, সরকারের পক্ষে দূতিয়ালী করতে সেদিন প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে নাটকীয়ভাবে দেখা করে বৈঠক করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে দ্রুত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ নেই বললেই চলে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু এবং সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যাওয়ার ঘটনা, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদুৎ, স্যাটেলাইট টিভি, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং পুনঃস্থাপন, খাবার বন্ধ, গুলশান থেকে বিএনপির কূটনীতি বিষয়ক নেতা রিয়াজ রহমানের ওপর হামলা, মন্ত্রী, এমপিসহ গুলশান এলাকায় দিনমজুর, খেটে খাওয়া শ্রমিক, ক্ষমতাসীনসহ সমমনা বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে তার কার্যালয় অভিমুখে প্রায়শই মিছিল, গুলশানে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনা দেশ-বিদেশে উদ্বেগের কারণ হয়েছে।তবে এসব বিষয় মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। নতুন আকর্ষণ হচ্ছে খালেদা জিয়ার কার্যালয় তল্লাশির জন্য আদালতের অনুমতি এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তল্লাশির অনুমতি পুলিশ পেলেও, গ্রেপ্তারি পরোয়না এর বেশ কয়েকদিন আগে জারি করা হলেও পরোয়ানার কপি পাওয়া কথা স্বীকার করেনি থানা পুলিশ।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলাকা এবং মহল্লা পর্যায়ে নাশকতা প্রতিরোধে কমিটি করার ঘোষণা দেন। এর কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রীর কাউন্টার দেয় বিরোধী জোট। তারাও সন্ত্রাস প্রতিরোধে পাল্টা কমিটির ঘোষণা দেয়। যদিও এখনও কোনো পক্ষের সংগ্রাম কমিটির অস্তিত্ব দেখা মেলেনি। এর আগেও বিএনপির এই ধরনের একটি কমিটির ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।গত ৩ জানুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে কার্যত অবরুদ্ধ। ৫ জানুয়ারি কার্যালয়ের নিচে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা দেন খালেদা জিয়া। সেই থেকে চলছে এখনও, আন্দোলনের প্রথম দিকে স্থানীয়ভাবে হরতাল দেয়া হলেও এবার কেন্দ্রীয়ভাবেই অবরোধের পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে হরতাল দেয়া হচ্ছে। সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা কটিয়ে উঠতে না পারায় এসব কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা যাচ্ছে না। মানুষ চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হচ্ছে।