দৈনিকবার্তা-যশোর, ০৯ মার্চ: যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। যা এখন কারাগারে ওপেন-সিক্রেট ঘটনা। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না।কারা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে কারাগারে বন্দী আসামিদের জন্য ক্যান্টিন প্রথা চালু করা হয়। এখান থেকে বন্দী আসামিরা তাদের জমা টাকায় চা, পুরি, সিঙ্গাড়া, পরোটা, বিরিয়ানি, এমনকি সিগারেট পর্যন্ত কিনতে পারে। কিন্তু কারাগারে এসব জিনিসের মূল্য প্রায় তিনগুণ বেশি। ক্যান্টিনে বর্তমানে এককাপ লাল চায়ের মুল্য ৮ টাকা, ভাজি ৩০ টাকা, পরোটা ৮ টাকা, পুরি ৫ টাকা, সিঙ্গাড়া ৫ টাকা, বিরিয়ানি হাফ এক প্যাকেট ২২০ টাকা, সিগারেট এক প্যাকেট বেনসন ২৫০ টাকা, গোল্ডলিফ সিগারেট এক প্যাকেট ২০০ টাকা।
কারা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী এ ক্যান্টিনের নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট থাকতে হবে এবং ওই একাউন্টের মাধ্যমে সকল আয়-ব্যয় পরিচালিত হবে। কিন্তু গত সাত বছরেও একটি একাউন্ট খোলা হয়নি। নিয়মানুয়ায়ী ক্যান্টিনে একজন ম্যানেজার থাকবেন। তিনি একটানা তিনমাস এ দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর তাকে বদলি করতে হবে। কিন্তু এ কাজটি করা হয় না। যেসব কারারক্ষী জেলর ও সুপারের খয়ের খাঁ, বা ধামাধরা সাধরণত তারই এ দায়িত্ব একাধারে মাসের পর মাস পালন করে যাচ্ছেন। আর এদের সাথে রয়েছে জেলর ও সুপারের অবৈধ অর্থনৈতিক লেনদেনের সম্পর্ক। তার মাধ্যমেই কারা ক্যান্টিনের টাকা ভাগ বাটোয়ারা করা হয়।
এছাড়া, কারাগারের আসামিদের অভ্যর্থনা কক্ষের পাশে ক্যান্টিন নামে একটি স্টেশনারি দোকান রয়েছে। যার আয়ও ক্যান্টিন ফান্ডে জমা হবার কথা। কিন্তু এটিও হয় না। বন্দীদের সাথে দেখা করতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের বেশি দাম দিয়ে এই দোকান থেকেই মালামাল কিনতে হয়। নতুবা বাইরে থেকে কিনলে তা আসামিদের কাছে দিতে দেয়া হয় না। এমনকি বাড়ির খাবার ও ফলমুলও বন্দীদেরকে প্রদান করা হয় না। বলা হয় তারা ভেতর থেকে কিনে খেতে পারবে।
যশোর কারাগারের এই দুটি ক্যান্টিনে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মালামাল বেচাকেনা হয়। এসব মালামালের দাম দুই থেকে তিনগুন হওয়ায় প্রতিদিন গড়ে লাভ হয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। প্রতিমাসে গড়ে এ লাভের পরিমাণ ১০ লাখ টাকার উপরে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। আর এ টাকা প্রতিমাসে লুটপাট করেন জেলর মহিউদ্দিন হায়দার ও সুপার শাহজাহান আহমেদ। অথচ অধিদপ্তরের নিয়ম রয়েছে ক্যান্টিনের লাভের টাকা সংশ্লিষ্ট কারাগারের সকল কারারক্ষীর মাঝে ভাগ করে দেয়ার। কিন্তু এ লাভের একটি টাকাও দেয়া হয় না যশোরের কারারক্ষীদের। অথচ আশেপাশের জেলার কারগারে লভ্যাংশের এ টাকা রক্ষীদের মাঝে ভাগ করে দেবার নিয়ম চালু রয়েছে। এ নিয়ে বর্তমানে কারারক্ষীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অভিযোগ রয়েছে, কারারক্ষীদের মাঝে নিম্নমানের চাল ও আটা রেশনে সরবরাহ করা হচ্ছে। যা তারা কারো কাছে অভিযোগ করতে পারছে না। কেউ যদি অভিযোগ করে তাকে শাস্তিমূলক বদলী করা হয়। যা নিয়ে তাদের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। কারাগারের সিআইডির দায়িত্বরত কারারক্ষী জাহিদ তার নাম্বার বিহীন ওয়ালটন মোটর সাইকেল নিয়ে বন্দীদের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গিয়ে উৎকোচ আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয় অনেক বন্দির স্ত্রীদের নিয়ে ওই মোটর সাইকেলে চড়ে শহরময় ঘুরে বেড়ায় জাহিদ। বেনাপোলের অস্ত্র মামলার আসামি রিপনের স্ত্রীকে নিয়ে জাহিদকে ঘুরতে দেখেছে অনেক কারারক্ষি। এছাড়া জাহিদ প্রতিদিন দুপুরে কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মোবাইল সরবরাহ করে। আসামিরা জাহিদের ফোন দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কথাবার্তা বলে। এ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় জাহিদ। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বন্দীদের কারা অভ্যন্তরে বিশেষ সুযাগ সুবিধা দেয়ার কথা বলে জেলর ও সুপারের নামে এ টাকা তিনি আদায় করছেন।
জেলর এক আত্মীয়র কাছে গত বছর কারাগারে ৪৯টি গাছ কোন কারণ ছাড়াই নিলামে বিক্রি করে এক লাখ ২৮ হাজার টাকায়। খুলনার এ নিলাম ক্রেতা ৪৯টি গাছের স্থলে কেটে নেন ৫৫টি গাছ। অভিযোগ রয়েছে এ ৬টি গাছের টাকাও ভাগাভাগি করে নেন জেলর ও সুপার। একইসাথে নিলাম ক্রেতাসহ তার লোকজনকে নিয়ম বহির্ভুতভাবে কারা ক্যাম্পাসের ভেতরে ১৫ দিন থাকতে দেয়া হয়।
সুত্র জানায়, জেলর মহিউদ্দিন হায়দার ও সুপার শাহজাহান আহমেদ মিলে বর্তমানে যশোর কারাগারে চালিয়ে যাচ্ছেন অনিয়ম ও দুর্নীতি। তাদের দু’জনের যোগসাজসে ঠিকাদারদের মাধ্যমে বর্তমানে বন্দীদের খাওয়ানো হচ্ছে বাজার কুড়ানো তরকারি। যা খাবার অযোগ্য বলেই কারারক্ষীরা অভিযোগে জানিয়েছে। এক্ষেত্রে কারা প্রশাসনকে মোট বিলের ১০ ভাগ টাকা উৎকোচ প্রদান করে ঠিকাদাররা চালিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছামত অনৈতিক কারবার।
কারাগারে নিজস্ব গরু পালনের কোন নিয়ম না থাকলেও সুপার পালন করছেন ১৪/১৫টি গরু ও জেলর পালন করছেন ১০/১২টি গরু। আর গরু দেখাশোনার জন্য সুপারের বাসায় ২জন ও জেলরের বাসায় ২জন কারারক্ষী অবৈধভাবে কাজ করে থাকেন। এরমধ্যে একজন দুধ বিক্রি করে ও অপরজন গোয়াল দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন। গরুর খাবার আসে ভেতরের মহিষের খাবার থেকে। সরকারিভাবে পালন করা মহিষের কুড়া, বিচালী ও খৈল তাদের গরুকে খাওয়ানো হয়। ফলে এ কাজে তাদের কোন খরচ হয়না। এছাড়া দুই বাসায় রয়েছে একজন করে সুইপার, যেটিও নিয়ম বর্হিভূত। এরা গরুর গোয়ালসহ তাদের বাড়িঘর পরিস্কার করে। অথচ নিয়ম রয়েছে, তারা কারাগার ক্যাম্পাস পরিস্কার করবে। এছাড়া এখানে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে বন্দীদের সাথে দেখা করিয়ে দেয়ারও ব্যবস্থা আছে।
অভিযোগ রয়েছে, বন্দীদের সাথে অফিসে সোফায় বসে দেখা করে কথা বলা দুই হাজার টাকা। অফিসের জানালায় দাড়িয়ে কথা বলা এক হাজার টাকা। নিয়ম বর্হিভুত দেখা ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। আর এ কাজের দায়িত্ব পালন করেন সার্জেন্ট শামসুল হক।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে দুই হাজারে বেশি হাজতী ও কয়েদী রয়েছে। এসব বন্দীদের যে মানের খাবার দেয়ার কথা তার কোনটাই মানেন না ঠিকাদাররা। নিয়মানুযায়ী যশোর কারাগারে বন্দীদের খাবারের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। এ কমিটির প্রধান হচ্ছেন কারাগারের দায়িত্বরত চিকিৎসক। কিন্তু কারাগারের চিকিৎসকের পদ গত দু’বছর ধরে শুন্য রয়েছে। এছাড়া এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সুপার শাহজাহান আহমেদ, জেলর মহিউদ্দিন হায়দার, একজন সার্জেন্ট ও একজন সুবেদার। এ কমিটি প্রতিদিন মাছ, মাংস, সবজী, রুটি, কলাসহ সব খাবার দেখে শুনে পরীক্ষা করে কারা অভ্যন্তরে বন্দীদের মাঝে পাঠানোর অনুমতি দেন। কিন্তু বর্তমানে এ কমিটির প্রধান ডাক্তারের পদ শুন্য থাকায় এ সুবিধার পুরোটাই ভোগ করছেন জেলর মহিউদ্দিন হায়দার ও সুপার শাহজাহান আহমেদ। তারা উৎকোচের বিনিময়ে হাড্ডিসার খাসি নামধারি ধাড়ির মাংস, রুগ্ন গরু ভ্যানে তুলে কারাগার অভ্যন্তরে নিয়ে জবাই করা হয়। এছাড়া পচা মাছ, রুই মাছের স্থলে সিলভার কার্প মাছ, ডালের কোন মান নেই, বাজারের ফেলে দেয়া তরকারি এনে এখানে বন্দীদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর যাদের এ বিষয়টি দেখার কথা তারা কোন কিছু না দেখে অবৈধ টাকার বিনিময়ে সবকিছু বৈধ বলে গ্রহণ করছেন। একারণে বন্দীদের বলার কিছু থাকছে না। তাদের অভিযোগ করার কোন স্থান নেই। এখানে রক্ষকরাই ভক্ষকের ভুমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। এ কারণে তারা নিরবে চোখ বুজে সবকিছু মেনে নিচ্ছেন। এ বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত হলেই সবকিছু বেরিয়ে পড়বে বলে সূত্রটি দাবি করেছে।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর মহিউদ্দিন হায়দার জানান, কোন দুর্নীতির সাথে তিনি জড়িত নন বলে তিনি জানান। একই সাথে এসকল অভিযোগের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। কারাগারের সুপার শাহজাহান আহমেদের সাথে এসব বিষয়ে কথা বলা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি হয় না।