দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৬ ফেব্রুয়ারি: গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরেও আন্দোলনে অনড় ও অবিচল রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গ্রেফতারসহ যেকোন পরিণতির জন্য প্রস্তুত আছেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গ্রেফতার হলেও আন্দোলন থেকে একচুলও নড়বেন না বিএনপি চেয়ারপারসন।খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলেও চলমান দাবি আদায়ের গণআন্দোলন থেকে বিন্দুমাত্র পিছু হটবেন না বা আন্দোলন শিথিল করা হবে না বলেও জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকা একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র।বিএনপির গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার হতে পারেন এজন্য তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছন। ওষুধসহ ব্যবহারের জন্য কাপড় গুছিয়ে রেখেছেন। তার অনুপস্থিতে কিভাবে আন্দোলন চলবে সে ব্যাপারে আগে থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলনের ছক বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই তৃণমূল নেতাকর্মীরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাবে বলে গুলশান কার্যালয়ের সূত্র জানিয়েছে।
দলের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রেফতার হলেও যাতে কর্মসূচি পালনে কোন বিঘœ না ঘটে সেজন্য দায়িত্ব বন্টন করে রেখেছেন। নেতাদের মধ্যে একের পরে এক গ্রেফতার হলেও দায়িত্ব পালনের জন্য সিরিয়াল নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনি। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের নেতাদের মধ্যে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার জন্য মানসিক ও দলীয়ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আছেন। তিনি যে কোন পরিণতির জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান শীর্ষ নিউজকে বলেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে খালেদা জিয়া উদ্বিগ্ন নন। বরং আগের মতই দাবি আদায়ের আন্দোলনে অনড় রয়েছেন।তার কার্যালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গ্রেফতার আশঙ্কা নয়, গ্রেফতার হতে পারেন এমনটি ধরেই তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।সূত্র দাবি করে, খালেদা জিয়া আপোসহীন নেত্রী। কাজেই কোন ধরনের অন্যায়ের কাছে তিনি আপোস করেননি, করবেন না।
সূত্রটি আরো বলে, খালেদা জিয়ার জন্য গ্রেফতার নতুন কিছুই না। তিনি এর আগেও একাধিকবার জনদাবি আদায় ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন।খালেদা জিয়ার প্রেস উইংয়ের কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান বলেন, খালেদা জিয়া গত ৫ জানুয়ারি বিএনপির গুলশান কার্যালয় থেকে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য বের হওয়ার সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যেভাবে পিপার- ¯েপ্র নিক্ষেপ করেছে, তখনই প্রতিফলিত হয়েছে এরপরে আ’লীগ আরো কঠিন কাজ করতে পারে।
তিনি আরো জানান, এই সরকারের কোন ধরনের কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেমী খালেদা জিয়া বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। বুধবার দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকার একটি আদালত। পরোয়ানা রাজধানীর সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়েছে। এর পর থেকেই বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের আশেপাশে ও গেটে পুলিশ বাড়ানো হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যরা গুলশান এলাকায় টহল বাড়িয়েছে। যেকোন সময়ে গ্রেফতার হতে পারেন খালেদা জিয়া এমন খবর এখন দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে।বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে সংকট কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তীদেশ ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।বুধবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্বেগের কথা জানান মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিক। সেখান থেকে বাংলাদেশি সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী এ কথা জানিয়েছেন।খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি প্রসঙ্গে জাতিসংঘের অবস্থান জানতে চাইলে ডোজারিক বলেন, বাংলাদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় জাতিসংঘ মাহাসচিব অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের চলমান ঘটনা প্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বর্তমান সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগী হতে জাতিসংঘ মাহাসচিব বারবার তাগিদ দিয়ে আসছেন।
উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বুধবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন নিম্ন আদালত। একই মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আগামী ৪ মার্চ আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি ইতিমধ্যে তিনটি থানায় গেছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। তবে পুলিশ তা অস্বীকার করছে।
খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলেও আন্দোলন থেমে যাবে না বলে মনে করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বুধবার দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তারা এ কথা বলেন।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনীতি করতে হলে জেল হতেই পারে। কিন্তু বিএনপি একটি বড় দল। এর লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী। তাই ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) গ্রেফতার করলে আন্দোলন থেমে যাবে এটা ভাবা ভুল হবে। বরং আন্দোলন আরো গতি পাবে।
তিনি বলেন, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) অ্যারেস্ট হলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল চলবে। তার পরে যিনি দায়িত্বে আছেন তিনিই তখন নেতৃত্ব দেবেন।আর গ্রেফতারির পরোয়ানার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া হবে বলেও মন্তব্য করেন জেনারেল মাহবুব।স্থায়ী কমিটির আর এক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। এটা আইনি বিষয়। এ ব্যাপারে আইনজীবীরা কথা বলবেন।
এদিকে,গেটের ভেতর বসে আছেন একজন নিরাপত্তা কর্মী। ঝড়া পাতায় ভরে গেছে বাড়ির আঙ্গিনা, গেটের বাইরেরটাও ভরে আছে ঝড়া পাতায়। মনে হচ্ছে যেন পরিত্যক্ত একটি বাড়ি। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া গুলশান-২ এর ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়িটির হাল বর্তমানে এমনিই। যে কার্যালয়ে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত ছিল নেতাকর্মীদের ভিড়, কে কার আগে প্রবেশ করবে তা নিয়ে হতো রীতিমত প্রতিযোগিতা, সেই কার্যালয় এখন নেই কোন নেতাকর্মীর ভিড়, নেই কোলাহল।
গেটের সামনে গিয়ে ভেতরে তাকালেই মনে হচ্ছে ভূতুড়ে পরিবেশ। গেটের সামনে সাদা পোশাকে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা চেয়ারে বসে অলস সময় কাঁটাচ্ছেন। সামনে পাতা টেবিল। টেবিলে রাখা রয়েছে দু‘টি খাতা। টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে ভিডিও ক্যামেরা ও স্টিল ক্যামেরা নিয়ে বসে আছেন সাদা পোশাকের দুই জন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য।এই কার্যালয়েই প্রায় দুই মাস ধরে অবস্থান করছেন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে অবস্থান কালেই মারা গেছে তার আদরের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো।এমন পারিবারিক বেদনাবিধুর পরিবেশেও খালেদার পাশে নেই তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তার সঙ্গে শুধু আছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা রহমান, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান, একান্ত সহকারী শিমুল বিশ্বাস, মহিলা দল নেত্রী শিরিন সুলতানাসহ কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সব মিলিয়ে অনেকটা ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে।