দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি: সেনা বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার মামলায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত৷বুধবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুর রহমান এ আদেশ দেন৷ একই সঙ্গে তার আইনজীবীদের করা জামিন আবেদন নাকচ করে দেন আদালত৷আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ৷ শুনানি শেষে আদালত ১০দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন৷
এর আগে বিকেল তিনটার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে৷ সেনাবিদ্রোহের উসকানি দিয়ে সরকার উত্খাতের অভিযোগ গুলশান থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় মান্নাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ৷
পুলিশ জানায়, ওই মামলার জের ধরেই মঙ্গলবার রাতে ধানমণ্ডিরে স্টার কাবাব রেস্তোরাঁর সামনে থেকে মান্নাকে আটক করে র্যাব-২৷তবে মান্নার পরিবারের অভিযোগ, সোমবার দিনগত রাতেই বনানীর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়েছে৷ যদিও পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করেছে৷
বুধবার তাকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে গুলশান থানার সহকারী পরিদর্শক আব্দুল বারিক ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান তা মঞ্জুর করেন৷এ সময় মান্নার পক্ষে জামিন আবেদন করা হলেও বিচারক তা নাকচ করে দেন৷
আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মান্না বলেন, পেট্রোল বোমার বিপক্ষে আমি কথা বলেছি৷ আমি বলেছি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন হওয়া উচিত, নাশকতা হওয়া উচিত না৷
সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথা হয়নি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, আমি যে কনভারসেশন করেছি তা লাইন টু লাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ সামরিক বাহিনীর কারো সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি৷
ফাঁস হওয়া টেলিফোন কথোপকথনে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আলাপচারিতায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলা নিয়ে মান্নাকে কথা বলতে শোনা গেছে৷
এ বিষয়ে আদালতে মান্না বলেন,কনভারসেশনে আমি বলেছি,বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের কথা৷ লাশ ফেলার কথা বলিনি৷
আদালতে মান্নার রিমান্ড আবেদন বাতিল ও তার জামিন আবেদনের পক্ষে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নেতা সানাউল্লাহ মিয়া, মহসিন মিয়া এবং অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান শুনানিতে অংশ নেন৷ সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন মান্নান৷
এর আগে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে থেকে েেবলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে প্রিজন ভ্যানে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন৷
বেলা তিনটার দিকে মান্নাকে বহনকারী ভ্যানটি আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছায়৷ সেখানে থাকা নাগরিক ঐক্যের কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন মান্না৷ এ সময় কর্মীরা মান্না ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে বলে স্লোগান দিতে থাকেন৷ এ ছাড়া মান্না আদালতে পৌঁছানোর আগেই তাঁর স্ত্রী মেহের নিগার, মেয়ে নীলম মান্না, মেজো ভাই মোবায়দুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী বেগম সুলতানা আদালতে আসেন৷
গত সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনানীর একটি বাসা থেকে মান্নাকে গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয়ে একটি দল তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়৷ পরিবারের লোকজন মঙ্গলবার দিনভর খোঁজ করেও জানতে পারেননি তিনি কোথায় ছিলেন, কেমন ছিলেন৷ দিনভর মান্নার খোঁজ পাওয়া না এবং পুলিশ অস্বিকার করায় বনানী থানায় মান্নার ভাবী জিডি করেন এবং হাইকের্ােট রিট করেন৷ রিটে মান্নাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হাজিরের নির্দেশ দেয়া হয়৷
মঙ্গলবার রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে গুলশান থানায় হস্তান্তরের পরপরই গোয়েন্দা কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে৷
ঐ সময় গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) নুরুল আলম জানান, মান্নাকে থানায় হস্তান্তরের পর ডিবি কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলম জানান, র্যাব মান্নাকে আটক করেছিল৷ তাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে৷
এদিকে মান্নাকে হস্তান্তরের খবর শুনে গুলশান থানায় ছুটে যান তার স্বজনেরা৷ পরে সাংবাদিকদের স্বজনরা জানান, তারা গুলশান থানার ওসির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন৷ পরে তারা ডিবি কার্যালয়ে যান৷ সেখানেও মান্নার দেখা না পেয়ে অবশেষে ফিরে যান৷
থানা সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে গুলশান থানার এসআই সোহেল রানা সেনা বিদ্রোহের উসকানির অভিযোগে মান্নার বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে৷
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও মান্নার কথোপকথনের অডিও ক্লিপের ফাঁসের পর তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলে দেশজুড়ে৷
সোমবার মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ ‘আটক করেছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবারের৷ তবে পুলিশ তা অস্বীকার করেছে৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার ও ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার সকালে দাবি করেন, মান্নাকে আটক বা গ্রেফতার করার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷ পরিবারের অভিযোগ তারা খতিয়ে দেখছেন৷
মান্নার স্ত্রীর জানান, বনানীর ই-ব্লকের ১৭ /এ সড়কের ১২ নম্বর বাসা থেকে মান্নাকে তুলে নিয়ে গেছে সাদা পোশাকধারী পুলিশ৷ মান্না তার ভাতিজির বাসায় অবস্থান করছিলেন৷
দিনভর মান্নার খোঁজ পাওয়া না গেলেও রাত সাড়ে ১০টার দিকে আভাস পাওয়া যায় যে তাঁকে রাতের যেকোনো সময় থানায় হস্তান্তর করা হবে৷ শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ থানায় হস্তান্ত রের পর তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়৷
পুলিশের রমনা, মতিঝিল ও গুলশান বিভাগের ১১ থানায় মান্নার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, নাশকতা, লাশ ফেলাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে পুলিশ ২৪টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে৷
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের অন্যতম উদ্যোক্তা মান্নার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তির টেলিফোনে কথা বলার দুটি অডিও ক্লিপ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়৷
এতে মান্নাকে চলমান পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপের উদ্যোগে আগ্রহ প্রকাশ করতে শোনা যায়৷ পাশাপাশি বিএনপি জোটের আন্দোলন জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথা বলতে শোনা যায় তাকে৷
ওই অডিও টেপের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের পর সারা দেশে শুরু হয় তুমুল আলোচনা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাওয়ায় মান্নাকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷
এরইমধ্যে মঙ্গলবার ভোররাতে বনানীতে তার ভাইয়ের বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে মান্নাকে তুলে নেওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়৷
তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও আটকের ২১ ঘন্টা পর এই রাজনীতিবিদকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে র্যাব৷ সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে৷
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান জানান, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৩১ ধারায় মান্নার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়েছে, যাতে সশস্ত্র বাহিনীকে বিদ্রোহের উসকানি দেওয়া অভিযোগ আনা হয়েছে৷
মঙ্গলবার গুলশান থানার এসআই সোহেল রানার দায়ের করা এ মামলায় মান্নার সঙ্গে টেলিফোন আলাপে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে৷
অডিও টেপে ওই ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোন সংলাপে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় মান্নাকে৷
ওই ব্যক্তি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার আগ্রহ দেখালে মান্নাকে বলতে শোনা যায়, জুনিয়র সিনিয়রতো একটা ব্যাপার আছে৷ তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে ইফেক্টিভ যারা৷ অ্যান্ড হু আন্ডারস্ট্যান্ড, হু নো, এ রকম হলে ভালো৷
মানে যার সাথে শেয়ার করা যাবে, যিনি আমাকে এনলাইটেন করতে পারবেন এবং মে বি আমিও তাকে বুঝতে পারব, বোঝাতে পারব৷
বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে ডাকসুর দুই বারের নির্বাচিত ভিপি মান্না আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সংস্কারপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে কর্মীদের রোষের মুখে পড়েছিলেন৷
মান্নাকে আটকের খবরে বুধবার বিএনপির প্যাডে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ জানিয়ে অবিলম্বে তাকে পরিবারের কাছে ফেরত দিতে সরকারকে আহ্বান জানান৷
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, মান্না বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশ করে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্র করছিলেন৷
সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহ সংঘটনে কেউ উসকানি দিলে বা এ ধরনের কোনো কর্মকর্তা, নাবিক বা এয়ারম্যানকে তার আনুগত্য বা দায়িত্ব থেকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করলে তার শাস্তির জন্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ বিষয়ক দণ্ডবিধির সপ্তম অনুচ্ছেদের ১৩১ ধারা প্রযোজ্য হয়৷
এই ধারায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছ৷