দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি: মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে তার পরিবার। মান্নার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বেগম সুলতানা মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে বনানী থানায় জিডি করেন বলে জানিয়েছেন থানার ওসি ভূইয়া মাহবুব হাসান।সুলতানা জিডিতে দাবি করেছেন, সোমবার রাত ৩টা- সাড়ে ৩টার দিকে ৬-৭ জন লোক গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার বনানীর বাসা থেকেই মান্নাকে নিয়ে যায়।তিনি মান্নার সন্ধান চাওয়ার পাশাপাশি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছেন।
মান্নার মেয়ে নীলম মান্না বলেন, আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।এদিকে মান্নাকে আটকের খবর নাকচ করা হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।মাহমুদুর রহমান মান্নানাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ আটক করেছে বলে অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবার। তবে পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
মান্নার স্ত্রী মেহের নিগারের ভাষ্য, সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনানীতে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাঁর স্বামীকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এ সময় তারা কোনো পরোয়ানা দেখায়নি।তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার ও ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম আজ মঙ্গলবার সকালে দাবি করেন, মান্নাকে আটক বা গ্রেপ্তার করার কোনো তথ্য তাঁর কাছে নেই। পরিবারের অভিযোগের বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।মান্নার স্ত্রীর ভাষ্য, বনানীর ই-ব্লকের ১৭ /এ সড়কের ১২ নম্বর বাসা থেকে মান্নাকে তুলে নিয়ে গেছে সাদা পোশাকধারী পুলিশ। মান্না তাঁর ভাতিজির বাসায় অবস্থান করছিলেন।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বনানীর ওই বাসায় গেলে নিরাপত্তারক্ষীর পরিচয় দেওয়া মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, ভেতরে কেউ নেই। বাসার সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে গেছেন। গত রাতের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর দাবি করেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাই রাতের ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানেন না। তবে আজ সকালে এসে বাড়ির ফটক খোলা পেয়েছেন তিনি। যোগাযোগ করা হলে মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার দাবি করেন, তিনি বাসার বাইরে আছেন। মান্নাকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি বনানী ও গুলশান থানায় জানিয়েছেন।
মান্নাকে বনানীর যে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছে তাঁর পরিবার, সেখানকার একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সোমবার বার গভীর রাতে ওই বাসার সামনে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন তিনি।মঙ্গলবার সকালে বনানী থানা-পুলিশের একটি দল ও গোয়েদা সংস্থার সদস্যরা বনানীর ওই বাড়ি ও সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেখানে উপস্থিত থাকা বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব হাসান বলেন, তাঁরা কোনো অভিযোগ পাননি। তবে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মান্নার ভাই মোবায়েদুর রহমান, ভাইয়ের স্ত্রী বেগম সুলতানা ও ভাতিজি শাহনামা শারমিন সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার জন্য বনানী থানায় যান। মান্নার অবস্থান জানতে চেড়ে ভাইয়ের স্ত্রী বেগম সুলতানা বাদী ০য়ে জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সোমবার রাত তিনটার দিকে ডিবি পরিচয় দিয়ে চার থেকে পাঁচজন ব্যক্তি মান্নাকে মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যান।জিডির বিষয়ে বনানী থানার ওসি মাহবুব হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা যেভাবে গণমাধ্যম থেকে জেনেছেন, আমরাও ঠিক একইভাবে জানতে পেরেছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা জিডি গ্রহণ করেছি। আমাদের কাজ শুরু হয়েছে।তিনি বলেন, ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জিডিতে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মান্নার ভাতিজি বলেন, গত রাত ১১টার দিকে মান্না তাঁদের বাসায় আসেন। তখন তিনি একটি মাইক্রোবাস দেখতে পেয়েছেন।মান্নার ভাই প্রশ্ন তুলে বলেন, বনানীর মতো একটি এলাকা থেকে মান্নার মতো একজনকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হলো, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার।এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন মান্নাকে ডিবি পুলিশ নিয়ে গেছে। তারা একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। তাই তাঁদের শঙ্কা ছিল না। কিন্তু যখন তাঁরা সকালে টেলিভিশনে দেখতে পেলেন পুলিশ বলছে, ডিবি মান্নাকে নেয়নি। তখন সতর্ক হয়ে থানায় জিডি করেছেন বলে তিনি জানান।ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার নূর আলম জিজ্ঞাসায় বলেছেন, এ বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই।
গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেছেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আটক বা গ্রেপ্তার কোনোটাই করা হয়নি। তবে অন্য কোনো সংস্থা তাকে আটক করেছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংলাপের অন্যতম উদ্যোক্তা মান্নার সঙ্গে বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। এর ভিত্তিতে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, একটি অডিওতে খোকার সঙ্গে আলাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথা বলতে শোনা যায় মান্নাকে। আর অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনে সেনা হস্তক্ষেপে ভূমিকা রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক।
ফোনে এই আলাপচারিতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইউটিউবে প্রকাশিত এই অডিও টেপ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও আলোচনা চলছে। কথাবার্তার একপর্যায়ে বোঝা গেছে, আলোচনার বেশির ভাগ অংশই ভাইবারে হয়েছে। সেখান থেকেই তাঁদের কথোপকথন ধারণ করে ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে। দুটি টেলিফোন আলাপচারিতায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সাম্প্রতিক আন্দোলন পরিস্থিতি, সংলাপ, নাগরিক ঐক্যের উদ্যোগ, সরকারের পদক্ষেপ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিভিন্ন দেশের উদ্যোগ ও ভূমিকা, আন্দোলন চাঙা করার জন্য করণীয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছাড়িয়ে দেওয়া ও সেনাবাহিনীর ভূমিকাসহ নানা বিষয় উঠে আসে।
মাহমুদুর রহমান মান্না সোমবার এ ব্যাপারে বলেছিলেন, এই কথোপকথন তাঁরই। তবে তিনি অভিযোগ করেন, এটা প্রকাশ করা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর হস্তক্ষেপ। সরকার চাইলে কথোপকথন রেকর্ড করে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। খারাপ কিছু থাকলে আইনিভাবে মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু এটা প্রকাশ করতে পারে না। এটা কে প্রকাশ করল, কেন করল? সরকারের কাছে তার বিচার চান। এতে তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, কথোপকথন কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তা তাঁর জানা নেই।এমন পরিস্থিতিতে সোমবার শান্তি ও সংলাপ-এর দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের একটি গণমিছিল কর্মসূচি অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়।
কথোপকথন ফাঁস হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী তানজীব-উল আলম বলেন, এ বিষয়ে বিচার চাইতে হলে মাহমুদুর রহমানকে মামলা করতে হবে এবং তাঁকেই আদালতে প্রমাণ করতে হবে যে এই কথোপকথন অবৈধভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রের রেকর্ড করার সুযোগ আছে। এই কথোপকথনে রাষ্ট্রদ্রোহ বা ক্ষতিকর কিছু থাকলে সরকারও মামলা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কথোপকথন দলিল হিসেবে উপস্থাপন করলে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা এটি রেকর্ড করেছে। আর অবৈধভাবে রেকর্ড করা হলে আদালতের অনুমতি লাগবে এটি দলিল হিসেবে উপস্থাপনের। সে ক্ষেত্রে যারা প্রকাশ করেছে, তাদের বিষয়টি গৌণ হয়ে যাবে।
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তির সঙ্গে মান্নার টেলিফোনে কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে বাংলাদেশজুড়ে তুমুল আলোচনা চলছে। এসব ক্লিপে মান্নাকে চলমান পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপের উদ্যোগে আগ্রহ প্রকাশ করতে শোনা যায়। পাশাপাশি বিএনপি জোটের আন্দোলন জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথাও বলতে শোনা যায় তাকে।
এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্নাকে গ্রেপ্তারের দাবিও উঠেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকে।এদিকে ওই অডিও ক্লিপের কথোপকথনের সূত্র ধরে মান্নার বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ, রমনা ও পল্টন থানায় ছয়টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে।
শাহবাগার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর হলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কোন এসআই বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য নোট করা হলো উল্লেখ করে একটি জিডি করে থাকেন। তেমনি আজকে ( সোমবার) মান্না, খোকা ও অজ্ঞাত ব্যক্তির কথোপকথনের খবরটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার ওসি সিরাজুল ইসলাম থানায় জিডি করে রেখেছেন।পল্টন থানার ওসি মোরশেদ আলম বলেন, সোমবারের খবরের ভিত্তিতে মান্না, খোকা ও অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে থানায় জিডি করা হয়েছে।রমনা থানায় এই কথোপকথোনকে খবরকে ভিত্তি করে দুটি জিডি হয়েছে পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান।