দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি: ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনালে এ রায় ঘোষণা বরে।প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। মোট ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পাঠ করা হয়। রায়ের প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। রায়ের দ্বিতীয় অংশ বিচারক প্যানেলের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন পাঠ করেন এবং মূল রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
রায়ে বলা হয়, আসামি জব্বারের বিরুদ্ধে আনীত সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে প্রসিকিউশন।জব্বারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন সোমবার ধার্য করে আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-১। এর আগে গত বছর ৩ ডিসেম্বর এ মামলার বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। এটি ট্রাইব্যুনালের ১৭ তম রায় এবং ট্রাইব্যুনাল-১এ ঘোষিত ৮ম রায়। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটি অষ্টম রায়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে পলাতক জাতীয় পার্টি নেতা আব্দুল জব্বারের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউশন বলেছে, প্রত্যাশা মৃত্যুদণ্ড থাকলেও আদালতের এই রায়ের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা রয়েছে।রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউশন জাহিদ ইমাম বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। কিন্তু আমাদের চাওয়া ছিল মৃত্যুদণ্ড।ট্রাইব্যুনালে জব্বারের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আবুল হাসান।জব্বারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতবছর ১৪ আগস্ট অভিযোগ গঠন করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে ১৭ নভেম্বর শেষ হয়। জব্বারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হেলাল উদ্দিনসহ ২৪ জন সাক্ষী।
গত বছর ৮ জুলাই ট্রাইব্যুনালের এক আদেশে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জব্বারকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির হননি জব্বার। এ জন্য তাকে পলাতক ঘোষণা করা হলো। আবুল হাসানকে মামলায় পলাতক আসামি পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য রাস্ট্র নিযুক্ত (স্ট্যাট ডিফেন্স) আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।এর আগে গত ১২ মে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনীত পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে গ্রেফতারে পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। এ আসামি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন বলে তদন্ত সংস্থা সুত্র জানায়। গতবছর ১১ মে এ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগে আনুষ্টানিক অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তকরণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ।আনীত পাঁচ অভিযোগের মধ্যে ১ম অভিযোগে বলা হয়েছে, জব্বার মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়ার ফুলঝড়িতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। এছাড়া নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার শতাধিক বাড়িতে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন। ২য় অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ফুলঝুড়িতে একজনকে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন। ৩য় অভিযোগে বলা হয়েছে, নলিতে ১১ জনকে গণহত্যা ছাড়াও ৬০টি বাড়ির মালামাল লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন। ৪ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, ফুলঝড়িতে প্রায় দুইশত নিরস্ত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেন জব্বার। ৫ম অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জব্বার আঙ্গুলকাটা এবং মঠবাড়ীয়া থেকে ৩৭ জনকে আটক, মালামাল লুণ্ঠন, অপহরণ, নির্যাতন, ১৫ জনকে গুরুতর জখম এবং ২২ জনকে হত্যা করেন।মামলাটি তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. হেলাল উদ্দিন। জব্বার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় সময় পাক বাহিনীর সহযোগী মঠবাড়ীয়া থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
রায়ে বলা হয়েছে, জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একটিতে ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ তিনি করেছেন তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য হলেও বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে আদালত বলেছে।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের ইসলামীর গুরু গোলাম আযমকেও বয়স বিবেচনায় ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যিনি রায় ঘোষণার এক বছরের মধ্যেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।আনুমানিক ৮০ বছর বয়সী জব্বার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থান করছেন বলে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধে জব্বারকেই প্রথম কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পলাতক এই যুদ্ধাপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।রায় ঘোষণার সময় এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো.আনোয়ারুল হকও উপস্থিত ছিলেন।জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ীয়ায় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি যে সব অপরাধ ঘটিয়েছিলেন, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
প্রসিকিউশনের আনা ১ নম্বর অভিযোগ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়িতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার শতাধিক বাড়িতে লুট ও অগ্নিসংযোগ; ২ নম্বর অভিযোগ ফুলঝুড়িতে একজনকে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৩ নম্বর অভিযোগনলীতে ১১ জনকে হত্যা, ৬০টি বাড়ির মালামাল লুট ও অগ্নিসংযোগ এবং পঞ্চম অভিযোগ আঙ্গুলকাটা এবং মঠবাড়ীয়া থেকে ৩৭ জনকে আটক, মালামাল লুট, অপহরণ, নির্যাতন, ১৫ জনকে গুরুতর জখম এবং ২২ জনকে হত্যার জন্য জব্বারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আর চতুর্থ অভিযোগ- ফুলঝুড়িতে প্রায় দু’শ নিরস্ত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য জব্বারকে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ না দিলে আরো দুই বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে। তবে সেই সুযোগ নিতে হলে জব্বারকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত আসা ১৭টি রায়ের মধ্যে চারটি মামলায় মোট পাঁচজন পলাতক আসামির সাজার আদেশ হলো।ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং নবম রায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ফাঁসির আদেশ আসে।
আর দ্বাদশ রায়ে ফরিদপুরের বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারেরও সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হয়। পলাতক থাকায় এই চারজনের কেউ আপিলের সুযোগ পাননি। পেশায় প্রকৌশলী আব্দুল জব্বার ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে’ চেয়ারম্যান- মেম্বারদের ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সংগ্রাম যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত, তখনও মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে মঠবাড়িয়া-বামনা-পাথরঘাটা আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জব্বার সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে তাকে পরিচিত করিয়ে দেয় সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার রাজাকারদের রিং লিডার হিসাবে।প্রসিকিউশনের নথিতে বলা হয়, জব্বারের শ্বশুর ছিলেন পিরোজপুরের মুসলিম লীগের নেতা। শ্বশুরের হাত ধরেই একাত্তরে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে শান্তি কমিটি গঠন করা হলে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হন জব্বার। ১৯৭১ সালে এক জনসভায় জব্বার বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুদের স্থান এই পাকিস্তানের মাটিতে হবে না, হিন্দুদের সম্পদ সব গনিমতের মাল, সব কিছু মুসলমানদের ভোগ করা জায়েজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জব্বার আত্মগোপনে চলে যান। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা জিয়াউর রহমানের আমলে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেলে জব্বারও সক্রিয় হন।
১৯৮৬ সালে তিনি যোগ দেন সেনা শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে; পিরোজপুর-৪ আসন থেকে হন সাংসদ। ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে টিন ও চাল আত্মসাতের মামলা হয়। মামলা এড়াতে তিনি বিএনপিতে যোগ দিলেও ২০০১ জাতীয় পার্টিতে ফেরেন। পরে তিনি জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যানও হন।
সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম একাত্তরের শীর্ষ ৫০ যুদ্ধাপরাধীর একটি তালিকা করেছিল, যাতে আব্দুল জব্বারের নামও ছিল।মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিনোদ বিহারী বিশ্বাসের ছেলে যজ্ঞেস বিশ্বাস ১৯৭২ সালে জব্বারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করলেও পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে পট-পরিবর্তনের পর তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
২০১৩ সালের ১৯ মে ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা। তদন্ত শেষে গতবছর ২৯ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ১১ মে ট্রাইব্যুনালে ৭৯ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন এ মামলার প্রসিকিউটর মোহাম্মদ জাহিদ ইমাম। অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল ১২ মে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জব্বারকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় নিয়ম অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতেও তিনি হাজির না হওয়ায় গতবছরের ৮ জুলাই তাকে পলাতক ঘোষণা করে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।বিচার চালাতে রাষ্ট্রীয় খরচে জব্বারের পক্ষে আইনজীবী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় মোহাম্মদ আবুল হাসানকে। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ১৪ অগাস্ট আব্দুল জব্বারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৪ জন সাক্ষ্য দেন। তবে জব্বার পলাতক থাকায় তার পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিল না।দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গতবছর ৩ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে আদালত।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।৫ ফেব্র“য়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।
ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর দেইল্যা রাজাকার নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। গতবছর ৩ নভেম্বর আপিলের রায়েও তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে ২০১৩ সালের ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গতবছর ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।ওই বছর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারা দুজনই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।
২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গতবছর ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি। বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যু দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।দশম রায় আসে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর। জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়। তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
একাদশ রায়ে গতবছর ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে।এরপর ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়।গতবছর ২৩ ডিসেম্বর এরশাদ আমলের প্রতিমন্ত্রী ও একাত্তরে হবিগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে আদালত সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয়।এরপর ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশ আসে।আর চলতি বছরের প্রথম রায়ে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানকেও একই সাজা দেওয়া হয়।