দৈনিকবার্তা-মানিকগঞ্জ,২২ ফেব্রুয়ারি: মানিকগঞ্জে মাঝ পদ্মায় সারবোঝাই কার্গোর ধাক্কায় এমভি মোস্তফা-৩ নামে লঞ্চ ডুবে গেছে। এ ঘটনায় রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ৪৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা মৃতদেহ রাখা হয়েছে পাটুরিয়া ঘাটে। তাৎিক্ষণিকভাবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এখনো অর্ধশতাধিক নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পাটুরিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল সরকার। রোববার সাড়ে ১১টার দিকে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া যাওয়ার পথে মাঝ নদীতে লঞ্চডুবির ওই ঘটনা ঘটে।
এদিকে দুর্ঘটনার পর পাটুরিয়া নৌ-ফাঁড়ির পুলিশ কার্গো এমভি নার্গিসের মাস্টারসহ দুই কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- কার্গোর মাস্টার ইকবাল হোসেন ও লস্কর শহিদুল ইসলাম। আরিচা পোর্ট অফিসার সাজ্জাদ হোসেন জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাটুরিয়া থেকে এমভি মোস্তফা নামের লঞ্চটি প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে যাচ্ছিল। পদ্মা নদীর মাঝখানে সারবোঝাই একটি কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পরে এটি ডুবে যায়। এসময় অধিকাংশ যাত্রী পাড়ে উঠতে সক্ষম হলেও অনেকেই নিখোঁজ হয়। খবর পেয়ে মানিকগঞ্জ ও ঘিওর উপজেলার ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লঞ্চটির উদ্ধার কাজে লেগে পড়ে। এখনো অর্ধশতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে বলে জানান আরিচা পোর্টের ও্তই কর্মকর্তা।
এদিকে দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস, জেলা পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা, বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ এর কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিআইডব্লিউটিএর একটি উদ্ধারকারী টাগ জাহাজ দিয়ে লঞ্চটিকে টেনে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম মাওয়া ঘাট থেকে ঘটনাস্থলে রওনা দিয়েছে। এদিকে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মোস্তফার নিহত আরোহীদের প্রত্যেক পরিবারকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা সহায়তা ঘোষণা করেছে সরকার। রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. মো. শামছুদ্দোহা খন্দকার এ তথ্য জানান। তিনি জানান, সহায়তার নিহতদের পরিবারকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা দাফন বাবদ।আর মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসকের তহবিল থেকে আরো ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তিনি আরো জানান, লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়া কার্গো নার্গিস-১ পাটুরিয়া ঘাট থেকে জব্দ করা হয়েছে।
মাঝ পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় মৃত ও নিখোঁজদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট। শত শত লোক পদ্মাপাড়ে ভিড় করেছেন। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ৩১টি মৃতদেহ নদী থেকে উদ্ধার করে পাড়ে আনা হয়েছে। পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় সাড়ি দিয়ে রাখা হয়েছে মরদেহগুলো। ঘাট ঘিরে নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। এছাড়া নিখোঁজদের স্বজনরা পদ্মা পাড়ে বসে হাহাকার করছেন। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে বেঁচে আসা যাত্রী ঝিনাইদহের শৈলকোপার লাল্টু মিয়া জানান, তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দৌলতদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় এমভি মোস্তফা-৩ লঞ্চটি। পথিমধ্যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে বেশ কিছু যাত্রী সাঁতরে নদী পড়ে ওঠে। এরপর স্থানীয়রা উদ্ধার করে আরো অনেককে। তবে এখনও অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা ১১টার দিকে মালবাহী কার্গো এমভি নার্গিসের ধাক্কায় পদ্মা নদীতে ডুবে যায় এমভি মোস্তফা-৩ নামে লঞ্চ। ঘটনার পরে শতাধিক যাত্রী সাঁতরে তীরে ওঠে। এর মধ্যে নিখোঁজ থাকে শতাধিক যাত্রী। এর মধ্যে ঘটনার পরে নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। পরে উদ্ধারকারীরা এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নারী শিশু মিলে ৪৩ মতদেহ পাওয়া যায়।
এদিকে, দুর্ঘটনার পরে বিআইডব্লিটিসির টাগ দিয়ে উদ্ধার শুরু করা হয়। এ কাজকে তরান্বিত করতে মাওয়া থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রোস্তম পাটুরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। একই সঙ্গে ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ ও ডুবুরিদের ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মানিকগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিটিএ, নৌপুলিশ ও স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান, মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা, শিবালয় উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী আকবর, ইউএনও একেএম গালিভ খান ঘটনাস্থলে রয়েছেন। দুর্ঘটনার পরে নৌ-পুলিশ এমভি নার্গিস কার্গোর মাস্টার ইকবাল হোসেন ও লস্কর শহিদুল ইসলামকে আটক করে। মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ওসি রকিবুজ্জামান জানান, রোববার দুপুর ১২টার দিকে পাটুরিয়ার ঘাট থেকে দৌলতদিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার পরপরই মাঝনদীতে দুর্ঘটনায় পড়ে এমএল মোস্তফা-৩ নামের লঞ্চটি।
এ ঘটনায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কার্গো জাহাজ এমভি নার্গিস-১ এর চালকসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করেছে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা কে এম তারিক জানান, সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নদীতে তল্লাশি চালিয়ে ৩৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। নিহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস ডটকমকে বলেন, এখনো উদ্ধার অভিযান চলছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি সনাক্ত করে টেনে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। ঠিক কতজন যাত্রী এখনো নিখোঁজ রয়েছেন পুলিশ তা জানাতে না পারলেও কমফোর্ট লাইন ও রাজধানী এক্সপ্রেস নামে দুটি বাসের শতাধিক আরোহী নিয়ে লঞ্চটি পাটুরিয়া ছেড়েছিল বলে ঘাটের সুপারভাইজার জুয়েল রানা জানিয়েছেন। নগরবাড়ী থেকে ঢাকাগামী একটি কার্গো জাহাজ লঞ্চের মাঝামাঝি অংশে ধাক্কা দিলে ডান দিকে কাত হয়ে সেটি ডুবে যায়। লঞ্চডুবির পরপরই আশেপাশের লোকজন নৌকা ও ট্রলার নিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করে। এ সময় বেশ কিছু যাত্রী সাঁতরে অন্য লঞ্চ ও ট্রলারে উঠতে সক্ষম হন।
গোপালগঞ্জের কমফোর্ট লাইনের সুপার ভাইজার সাখাওয়াত হোসেন জানান, সকাল ৯ টার দিকে ঢাকার গাবতলী থেকে ৪৩ জন যাত্রী নিয়ে তিনি গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হন। দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ থেকে যাত্রীদের উদ্ধারের পর ৩৩ জনকে নিয়ে অন্য একটি বাসে করে তিনি বিকাল ৫টায় গোপালগঞ্জে পৌঁছান। বেঁচে যাওয়া লঞ্চযাত্রী স্বাপ্না বেগম (২৫) বলেন, সবার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। বেঁচে ফিরতে পারব বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না। গোপালগঞ্জ কমফোর্ট লাইনের ম্যানেজার হামিদুর রহমান টিটো বলেন,নিখোঁজরে জন্য আমরা নদীর তীর, শিবালয় ও মানিকগঞ্জ হাসাপাতালে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। রাজধানী এক্সপ্রেসের কতজন যাত্রী ওই লঞ্চে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কতজন এখনো নিখোঁজ তা জান যায়নি।
মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা জানান, বিআইডব্লিউটিসির একটি টাগবোট ডুবে যাওয়া লঞ্চটির অবস্থান সনাক্ত করে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। মানিকগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি এবং পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ি ও দৌলতদিয়া পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নিচ্ছেন। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমও দুর্ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান খন্দকার শাসুদ্দোহা জানান। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জানান, নদীতে ২০ ফুট পানির নিচে এমএল মোস্তফার অবস্থান সনাক্ত করা হয়েছে। লঞ্চটির ওজন প্রায় ৫০ টন। রুস্তম পৌঁছানোর পর সেটি টেনে তোলা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি। উদ্ধার কাজের তদারক করতে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন। জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরাসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সেখানে রয়েছেন। পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খোলা হয়েছে দুটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল জানান, লঞ্চডুবির ঘটনায় যাদের উদ্ধার করা হচ্ছে তাদের তাৎক্ষণিক সেবা দিতে ঘটনাস্থলে একটি মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে।
শিবালয়ের ওসি রকিবুজ্জামান জানান, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কার্গো জাহাজ এমভি নার্গিস-১ এর চালকসহ তিনজনকে ঘটনার পরপরই আটক করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম খান জানিয়েছেন।