দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি: বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বানকি মুন।বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাস্তবসম্মত উপায় খুঁজে বের করতে সরকারকে পরামর্শও দেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। দীর্ঘ মেয়াদি স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা করারও পরামর্শ দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস সামিট টু কাউন্টার ভায়ালেন্ট এক্সট্রেমিজম’ শীর্ষক সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাক্ষাৎ করেন।এ সময় বান কি মুন এসব মন্তব্য করেন। ওয়াশিংটনে চলমান সহিংস চরমপন্থা মোকাবেলায় হোয়াইট হাউস সামিট’-এর ফাঁকে এ বৈঠকে অংশ নেন তারা। বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন- যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক।
জাতিসংঘের বিবৃতিতে জানানো হয়,এ সময় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের কাজের সঙ্গে, বিশেষ করে শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অবদানের জন্য বান কি মুন ধন্যবাদ জানান।২০১৫ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার ও জীবনহানির ঘটনায় বান কি মুন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।চলমান সহিংসতার ব্যাপারে জাতিসংঘের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিবৃতিতেও জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সহিংসতা থেকে সাধারণ মানুষ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি মেনেই সব দলকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করা উচিত।এছাড়া স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিরোধীদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ করতেও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের মহাসচিব জানান, জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের।তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনেই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের কর্মসূচি পালন করা।
এ সময় সচল ও অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তার সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে বলে জাতিসংঘের মহাসচিবকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।তিনি বিএনপি-জামায়াতজোটের সহিসংতা থেকে জনগণকে নিরাপদ রাখতে সরকারের তৎপরতার বিষয়েও জাতিসংঘের মহাসচিবকে অবহিত করেন। বৈঠকে জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।এ সময় বানকি মুন বলেন, রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জাতিসংঘ সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে।সহিংসতা থেকে জনগণকে রক্ষার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে কার্যকর পথ খোঁজার তাগিদ দেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন।
সেই সঙ্গে উন্নয়নের স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন তিনি।যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আহ্বানে হোয়াইট হাউজে সহিংস উগ্রপন্থা নির্মূল বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে আছেন মাহমুদ আলী।গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে সহিংসতায় প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির উত্তরণ প্রত্যাশা করে এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসনকে চিঠি পাঠিয়েছেন বান কি মুন।এদিনও বৈঠকে বাংলাদেশে অবরোধ-হরতালে সহিংসতায় প্রাণহানিতে মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে তার এক মুখপাত্র জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নিরীহ জনগণের সুরক্ষা এবং মানবাধিকার রক্ষায় সরকার কাজ করছে বলে বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, সহিংসতা থেকে জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব সরকারের এবং গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সব দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত।বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া জোরদারে জাতিসংঘের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন মহাসচিব।রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পেতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশেষ অবদানের পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানান মহাসচিব বান কি-মুন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা নিসরনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মহাসচিবের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।জাতিসংঘের ঢাকা অফিসের মুখপাত্র লিন্ডসে লিঞ্চ বলেন, মহাসচিব কয়েকদিন আগেচিঠিটি পাঠিয়েছেন। চিঠিটি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে চিঠির মধ্যে কি লেখা রয়েছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি।
জানা গেছে,চিঠিতে বানকি মুন চলমান সহিংসতায় প্রাণহানিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক মত পার্থক্য নিরসনে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।এদিকে দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মহাসচিবের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন,বাংলাদেশের সহিংসতায় প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে বান কি-মুন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
তারানকো বাংলাদেশ সফরে সরকার অনুমতি দিচ্ছে না-গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তারানকোর ঢাকা সফরের কোনো পরিকল্পনা নেই।তাকে সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি তার উদ্যোগ অব্যাহত রাখবেন।
এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাক্কালে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ২০১৩ সালেও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখে ছিলেন বান কি-মুন। ওই সময় তিনি দুই নেত্রীকে টেলিফোনও করেন।বান কি-মুনের দূতিয়ালিতে সে সময় দুই দফা ঢাকা সফর করেন অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো। ঢাকায় এসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বসে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
বান কি-মুনের দূতিয়ালির পরও সে সময় সংলাপ ব্যর্থ হয়। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। রে সহিংসতার মধ্যে ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সারা দেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন।
অবরোধের পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচিও ঘোষণা করেন তিনি। তার এই কর্মসূচি ঘোষণার মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল বোমা হামলা চলছে।সরকারি হিসেব মতে, গত দেড় মাসে পেট্রোল বোমা ও ককটেল হামলায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ৯০ জন, আহত হয়েছেন ৫৫৬ জন। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা শ’য়ের কাছাকাছি।
প্রাণহানি ছাড়াও এ সময় ৬৬৪টি যানবাহন পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৪১০টি যানবাহন ভাঙচুর করেছে অবরোধ সমর্থকরা। ২৮টি স্থাপনা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ২৫টি। নৌপথে ছয়টি।সরকার এই হামলার জন্য বিএনপি ও জামায়াত শিবিরকে দায়ী করেছে।আর চলমান সংকট নিরসনে বাংলাদেশের চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী যথোপযুক্ত ব্যবস্থা ব্যবস্থা নেবেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।গত কয়েকদি আগে জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিক মুশফিকুল ফজলের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক।
মুশফিকের প্রশ্নটি ছিল, জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী ও আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। চিঠি পাওয়ার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখেছি, তারা চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। আর সরকার পক্ষ সংলাপে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা বলেছেন, সংলাপের কোনো প্রশ্নই উঠে না। তারানকো একটি রুটিন চিঠি পাঠিয়েছেন এবং অনেকবারই জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। সুতরাং সংলাপ বা অন্যকিছুর শর্তাবলিতে কিছুই হবে না। তারানকোকে সংলাপ বা বিরোধীদের সঙ্গে সমস্যার সমাধানে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সংলাপের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় জাতিসংঘের অবস্থান কি?জবাবে মুখপাত্র বলেন, আমরা আগেও বলেছি, অবশ্যই মহাসচিব সহিংসতার বিষয়ে উদ্বিগ্ন,যে রাজনৈতিক সহিংসতা আমরা দেখেছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তারানকোকে মহাসচিবের পক্ষ থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে। তিনি পরিস্থিতি নজরে রাখবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।