দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি: টানা অবরোধ আর হরতালের মধ্যেও রাজধানীর বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তবু বাড়ছে দাম। ২০-দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ আর হরতালের ফাঁদে পরো রাজধানীর বাজার। পাইকার আর পণ্য সরবরাহের স্বল্পতায় প্রতিদিনই পণ্যের দাম ওঠানামা করছে। আর্থিক ক্ষতি আর ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আড়তদার, পাইকার, বিক্রেতা, শ্রমিক ভালো নেই কেউ-ই। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে এ অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি পরিবহন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পুলিশি প্রহরায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করছে। এ কারণে পণ্যবাহী পরিবহন ভাড়া দ্বিগুণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। অন্যদিকে দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
অন্যদিকে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে খুচরা ক্রেতা সমাগম কমে গেছে। দোকান খোলা থাকলেও পণ্য বিক্রি কমেছে কিছুটা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সবধরনের পণ্যর দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২ থেকে ৪ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, হরতাল-অবরোধের কারণে জীবনের ঝুঁকি থাকায় অনেকেই ট্রাক নিয়ে রাজধানীতে আসতে চায় না। তবে কিছু পণ্যবাহী ট্রাক পুলিশের নিরাপত্তায় প্রবেশ করছে। যার ফলে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এসব পরিবহনের খরচ দ্বিগুণ হওয়ার কারণে পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে।
শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ানবাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। অবরোধের আগে তা বিক্রি হতো ২ হাজার ৩০০ টাকায়। নাজিরশাইল ২ হাজার ৪০০ টাকা। যা আগে ছিল ২ হাজার ৩০০ টাকা। বিআর ২৮ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। এছাড়া পোলাওয়ের চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়।
অন্যদিকে, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজি দরে। আর ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকা কেজি দরে। কিছুদিন আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হতো ২৮ থেকে ৩০ টাকায়। দেশি মসুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা কেজি ও বিদেশি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, মান ভেদে প্রতিকেজি আলু (লাল) ৭ থেকে ১০ টাকা, ডায়মন্ড ৮ থেকে ১২ টাকা, সিম ১৬ থেকে ২০ টাকা, গাজর ১০ থেকে ১৩ টাকা, শালগম ১৬ টাকা, শসা ২০ টাকা, চিচিঙ্গা ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা, বেগুন ১৮ থেকে ২২ টাকা, কাঁচামরিচ ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ানবাজারের লাকসাম ট্রেডার্সের মালিক বেলায়েত হোসেন জানান,হরতাল-অবরোধের কারণে স্বাভাবিকভাবে চাল রাজধানীতে আসছে না। পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগে যেখানে ১০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দিতে হতো; এখন সেখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এ কারণে দাম বেড়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, ট্রাকের ভাড়া কোথাও কোথাও বেড়েছে। তবে সেটা কোনোভাবেই দ্বিগুণ নয়। কারণ মহাসড়কগুলোতে এখন ৭০-৮০ শতাংশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করছে। গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য পরিবহন খরচ দ্বিগুণ হওয়ার অভিযোগটি সত্য নয়। পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে অনেকেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
মৌলভীবাজার মা ট্রেডিং কর্পোরেশনের প্রোপাইটর কার্তিক কান্তি জানান, অবরোধের কারণে অনেকেই পাইকারি বাজারে আসতে পারছেন না। পাইকারি বাজারে স্বাভাবিকের তুলনায় দাম কম। তবে পণ্য সরবরাহ ও মজুদ স্বাভাবিক রয়েছে। অবরোধের আগে প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ টাকার বিক্রি হতো আমার দোকানে। সেই বিক্রি এখন ১ লাখ থেকে ৫০ হাজার টাকায় নেমেছে। পরিবহন খরচ দ্বিগুণ দিয়ে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো কোনো ট্রাক ড্রাইভার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে রাজি হন না। সে ক্ষেত্রে ১২ হাজার টাকার ভাড়া তারা নেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা সোনালী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাসেম বলেন, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। পাইকারি বাজারে খুচরা বিক্রেতারা কমে যাওয়ায় ব্যবসা কমেছে।এদিকে বেশ কিছু পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বিষয়টি খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) স্বীকার করেছে। টিসিবির হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডিসেম্ব^রের তুলনায় জানুয়ারিতে সব পণ্যের দাম চড়া। সর্বনিম্ন ১ টাকা থেকে ৫ টাকা বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যে।এদিকে, গত কয়েকদিনে নাশকতাকারীরা বেশ কিছু পণ্যবাহী ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়েছে। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি মুরগির বাচ্চাবাহী ট্রাকও। এমনকি বইবাহী ট্রাকেও আগুন দিয়েছে তারা।
মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি, পুলিশসহ আনসার বাহিনী কাজ করছে। এতে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন পরিবহন মালিকরা।এদিকে, স্বাভাবিক হয়ে আসছে দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। চলমান অবরোধ সহিংসতার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছিল খাতুনগঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা এবং ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় টাণ ফিরে পাচ্ছে দেশের অন্যতম এই পাইকারি বাজারটি।
গত একমাসে হরতাল-অবরোধের কারণে পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাজার ছিল প্রায় ক্রেতাশূন্য। এমন পরিস্থিতিতে স্থবির ছিল চট্টগ্রামের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমে আসায় চলতি মাস শেষ হওয়ার আগেই মোট লেনদেন ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শুক্রবার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেচা-কেনা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে সবকটি পথ এখন পণ্যবাহী যানবাহনের দখলে। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে পণ্য ওঠা-নামানোতে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা। ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষি আর হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত ছিল বাজারের সবকটি দোকান।
হরতাল অবরোধের অজুহাতে বেড়ে যাওয়া পরিবহন ব্যয় কমেছে। পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় যথাসময়ে বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে সব ধরনের আমদানি পণ্য। চট্টগ্রামের বাজারে কমতে শুরু করেছে পেঁয়াজ, আদা, চাল-ডালসহ সব ভোগ্যপণ্যের দাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্রাক, ভ্যান নৌকায় বোঝাই করে পণ্য নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা।
সকালে বাজার থেকে প্রায় ৫ শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি দেশের বিভিন্ন গন্ত ব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। মাঝিরঘাট এলাকার ১৬টি ঘাট দিয়ে সকাল থেকে পণ্য বোঝাই শতাধিক নৌকা পাশের কয়েকটি উপজেলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সগির আহমদ বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসায় আমদানি পণ্যে বাড়তি ভাড়াসহ পরিবহন জটিলতা কমেছে। ফলে সব ধরনের পণ্যের দাম স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। বেড়ে গেছে বেচা-কেনা। সব কিছু ঠিক থাকলে গেল মাসে ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আমদানিকারকরা নির্ভয়ে তাদের আমদানি করা পণ্য গোডাউনে তুলতে পারবে।চাকতাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাজার অনেকাংশে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তিনি জানান, পরিবহন খরচের কারণে পণ্যের যেটুকু দাম বেড়েছিল তা কমে আসছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুরোপুরি ফিরে এলে দেশের অর্থনীতি আবারো ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।