দৈনিকবার্তা-যুক্তরাজ্য, ৮ ফেব্রুয়ারি: বাংলাদেশের ‘বাবা ট্যাবলেট’ ওরফে ইয়াবা শেষ পর্যন্ত ঘুম হারাম করেছে যুক্তরাজ্য, ইতালী, ফ্রান্স সহ ইউরোপের বেশ ক’টি দেশের গোয়েন্দা পুলিশের। মধ্যপ্রাচ্যের যে দু’টি দেশে সবচাইতে বেশি বাংলাদেশীর বসবাস সেই সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশও নড়েচড়ে বসছে লাল রঙের ‘মরণ নেশা’ সুগন্ধী ক্যান্ডি তথা ইয়াবার ক্রমবর্ধমান চালান ঠেকাতে। শাক-সবজী আচার-শুটকির প্যাকেটের আবরণে অনেক আগে থেকেই চালান হওয়ার পাশাপাশি এখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ও কেবিন ক্রুদের ব্যাগেজ ভরে ইয়াবা আসতে শুরু করায় নতুন এই উদ্বেগ।
সাময়িক ‘যৌন উত্তেজক’ বড়ি ইয়াবার অনুপ্রবেশ অবশ্য নতুন নয় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ এমন তথ্য অনেক আগেই জানিয়েছিল যুক্তরাজ্যের ‘ড্রাগ ইনফরমেশন’। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা বিপ্লবের নেপথ্যে আজ অবধি সাগর পাড়ের এক এমপি’র নাম বারবার উচ্চারিত হলেও অন্ধকার এই জগতের গডফাদারদের সাথে সরকারের অন্ততঃ দু’জন মন্ত্রী নিবিড়ভাবে কাজ করছেন বলে শোনা যায়। বাবা ট্যাবলেটের রমরমা বানিজ্যে এমপির পাশাপাশি বাংলাদেশের মন্ত্রীরাও যে জড়িত, তা ঢাকার সংবাদ মাধ্যম চেপে গেলেও এতদসংক্রান্ত নিশ্চিত তথ্য এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের গোয়েন্দাদের কাছে।
অবৈধ ইয়াবার সন্ধানে লন্ডনের ইমিগ্রেশন পুলিশ সাম্প্রতিককালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ও কেবিন ক্রুদের ব্যাগেজও তল্লাশি করতে শুরু করেছে। ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্তৃক তাদের ‘পাসপোর্ট চেক’ বা ‘ব্যাগেজ সার্চ’ করার নজির না থাকলেও গত ৩১ জানুয়ারী লন্ডনে ঘটে সেই অঘটন। পাসপোর্ট ছাড়াই বিমানবন্দরের বাইরে যাবার সময় বিমানের সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন রফিককে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং বিমানবন্দরের ভেতর বসিয়ে রেখে বাধ্য করা হয় তাকে ফিরতি ফ্লাইটেই ঢাকা ফিরে যেতে। বিনা পাসপোর্টে ক্যাপ্টেন কর্তৃক যুক্তরাজ্যে ঢুকতে চেষ্টার অপরাধে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তথা বাংলাদেশের সৌভাগ্য এজন্য যে, ঠিক সেদিনকার ফ্লাইটে ইয়াবার চালান আসেনি। তবে পাইলট ও কেবিন ক্রুরা কাঁচা পয়সার এই লোভনীয় বানিজ্য বন্ধ না করলে বড় ধরণের অঘটন ঘটবে যে কোন মুহূর্তে, এমনটাই আশংকা এখন পুরো ইউরোপ জুড়ে। বিমানের কার্গোর বদান্যতায় ঢাকা থেকে অবশ্য ২০০৯ সাল থেকেই লন্ডন ও রোমে সরাসরি আসছে মরণনেশা ইয়াবা। ‘হট বিজনেস’ হিসেবে দ্রুতই তা সম্প্রসারিত হয় মধ্যবর্তী দেশ ফ্রান্সে। ইউরোপের রেসিডেন্স এবং বিজনেস লাইসেন্স থাকার সুযোগে সবজী আমদানীকারকরা ঢাকার কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে দিয়ে ৬ বছর যাবত ফ্রি-স্টাইলে করছে ইয়াবা বানিজ্য।
লন্ডন-রোম-প্যারিসের পথ ধরে গোটা ইউরোপে বাংলাদেশী অধ্যুষিত বড় শহরগুলোতে ইয়াবার বাজার আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝুঁকির মুখে এখন ইউরোপে বাংলাদেশের সবজী রফতানী। কারন দেশে দেশে ট্যাক্স পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ এমনকি বিশেষ অপরাধ দমন ইউনিটগুলোও গভীর নজরদারিতে রেখেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশীকে। সূত্রমতে, ডালপালা না কেটে সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে চায় বিভিন্ন দেশের প্রশাসন। এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাকটেরিয়া যুক্ত পানের ওপর গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ থেকে আসা সবজীতেও ব্যাপক পোকামাকড় এমনকি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। পোকামাকড় ও ব্যাকটেরিয়ার সাথে ইয়াবা ইস্যু এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশী সবজীর ওপর বহুমূখী নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যেখানে ১৪শ’ কোটি টাকার সবজী রফতানীর লক্ষমাত্রা, সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সবজীর মোড়কে ইয়াবা পাচার বন্ধ করা না হলে ঢাকার বানিজ্য মন্ত্রনালয় বা রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর ইইউ সংক্রান্ত সব ‘অ্যাকশান প্ল্যান’ মাঠে মারা যাবে যে কোন সময়। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপে সবজীর বাজার ধরে রাখতে বা ফিরে পেতে শুধু পোকামাকড় ও ব্যাকটেরিয়া নিয়ে বসে থাকলে এখন আর কোন কুলকিনারাই করা যাবে না।
সম্ভাব্য যে কোন বিপর্যয় মোকাবেলায় স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এমনকি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে বিদেশে ইয়াবা পাচার রোধে। এদিকে নৈতিক মূল্যবোধেও রীতিমতো ‘লালবাতি’ জ্বলে গেছে দেশে দেশে বাংলাদেশী নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশে। বাবা ট্যাবলেট তাদের কাছে এতোটাই মহৌষধ যে, একবার যারা ধরেছে তারা নিজেরা না ছেড়ে বরং জনপ্রতি আরো দশজনকে নিয়ে এসেছে নিজস্ব রঙীন ভূবনে। ফলে দেশে দেশে বাড়ছে একের পর এক সামাজিক অপরাধ। লন্ডনে আমেরিকান ছাত্রের উপর হামলার ঘটনায় অতি সম্প্রতি যে ৫ জন ব্রিটিশ-বাংলাদেশী তরুণকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছে আদালত, তাদের সবাই অনেক আগে থেকেই ইয়াবাতে অভ্যস্ত ছিল বলে জানা গেছে।
মরণনেশা ইয়াবার ব্যাপক বানিজ্য বিস্তার লাভ করায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তির নতুন করে বারোটা বাজতে এখন খুব একটা বাকি নেই। আগে থেকেই যেখানে ব্যাপক অপরাধমূলক অপকর্মের জন্য টানা ৭ বছর বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি বন্ধ রাখে সৌদি সরকার, অথচ এখনও প্রতি সপ্তাহেই দেশটির কোন না কোন শহরে ইয়াবা সহ হাতেনাতে ধরা পড়ছে বাংলাদেশীরা। নেশার নেটওয়ার্কে এরা সামান্য ডালপালা হওয়ায় শরীয়া আইনে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে বেত্রাঘাত। গত ২ বছরে অন্ততঃ অর্ধ শতাধিক বাংলাদেশী ক্ষুদ্র ইয়াবা ব্যবসায়ীর স্থান হয়েছে পবিত্রভূমির বিভিন্ন কারাগারে। দুবাই-আবুধাবীতেও ইয়াবা সহ ধরা পড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশের নাগরিক। ঢাকার কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা চালান হচ্ছে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। বাবা ট্যাবলেটের ব্যাপক চালানের ‘মেকানিজম’ সৌদি গোয়েন্দা বিভাগ এখনো পুরোপুরি ধরতে সক্ষম না হলেও অনুসন্ধান তারা শুরু করেছে ইতিমধ্যে জোরেশোরে। শ্রমবাজারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ঢাকার তরফ থেকে বারবার যখন প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশীরা নতুন করে দেশটিতে কোন ক্রাইমে আর জড়াবে না, সেখানে ঠিক একই সময়ে সৌদি গোয়েন্দা বিভাগ মাঠে নেমেছে ইয়াবার উৎস সন্ধানে। ঢাকার ইয়াবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার তথা দুই-তিন জন এমপি-মন্ত্রীর অবৈধ ‘ইয়াবা ধান্ধা’র চাইতে সৌদির শ্রমবাজার এবং ইউরোপের সবজী বাজারকে গুরুত্ব দেয়ার এখনই কিন্তু উত্তম সময়।