দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১লা ফেব্রুয়ারী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠল মাসব্যাপী একুশের বইমেলার।প্রতি বছরের মতো এবারও ১ফেব্র“য়ারি রোববার বিকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়। গত বছরও নির্বাচনের আগে বহু মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলাম।১জানুয়ারি নতুন বই তুলে দিয়েছি।দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। যখনই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যায় তখনই আঘাত আসে। বাঙালি জাতি বীরের জাতি বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের কাছে মাথানত করবে না। তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও আহবান জানান। রোববার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাঙালির প্রাণের বইমেলার উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন তিনি। উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে বইমেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনেরও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। বইমেলা শুধু মেলাই নয়, জ্ঞান অর্জনেরও সুযোগ করে দেয়। শুধু জ্ঞানই দেয় না, জীবনকে গড়ে তোলার সুযোগও পাওয়া যায় বই পড়ার মাধ্যমে। বই তাই আমাদের সব ধরনের মনের খোরাক যোগায়।প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল মাতৃভাষা রক্ষার জন্য। রক্ত দিয়ে আমরা সে অধিকার রক্ষা করেছি। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি মিলিত হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। অমর একুশেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম বিজয়গাথা। সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংস্কৃতি সংস্কৃতিক্ষেত্রে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। দেশের প্রকাশনাকে উৎসাহ দিতে একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে ই-বুক প্রচলনের ব্যবস্থা করেছি। তথ্যপ্রযুক্তির ধারায় বাংলাভাষাকে গতিশীলভাবে যুক্ত করতে অভিন্ন ও সহজসাধ্য বাংলা ফন্ট প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলমান আছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একুশে ফেব্র“য়ারি মহান শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।আমরা ভাষার উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়িত করে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি। মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাক সে কামনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। আর যেন মানুষ হত্যা না হয়, সেজন্য চলমান আন্দোলনের নামে নাশকতা বন্ধের আহবান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে কেউ যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তার খেসারত তাকেই দিতে হবে। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ কি অপরাধ করেছে যে, তাদের পুড়িয়ে মারতে হবে।
ককটেল, বোমাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।তিনি বলেন, এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ, আমরা শিশুদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।উদ্বোধন শেষে গ্রন্থমেলা পরিদর্শন করেন ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় মহান একুশের চেতনালালিত মাসব্যাপী এ মেলা।বাংলা একাডেমির আয়োজনে মাসব্যাপী এ মেলা এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে দু’ভাগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।বিকেল তিনটায় বাংলা একাডেমি চত্ত্বরে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা’২০১৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।একই মঞ্চে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে আসা বিদেশি অতিথিদের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জার্মানির সাহিত্যিক হান্স হার্ডার, ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য গবেষক ও ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’২০১৫ প্রাপ্ত লেখকের হাতে পুরস্কারের ক্রেস্ট, সম্মাননাপত্র ও এক লাখ টাকা তুলে দেন। অনুষ্ঠানে সিলেটের শিশুশিল্পী সিরতাদুল মুরতাহা লামিয়া কবিতা আবৃত্তি করে।এ বছর মেলায় মোট ৩শ’ ৫১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। মেলা প্রাঙ্গণে মোট ৫শ’ ৬৫টি ইউনিট ও ১১টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোট ২৯৫টি বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ৪৭৫ ইউনিট স্টল রয়েছে। ১০টি প্রতিষ্ঠানকে প্যাভিলিয়ননের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠান মূল একাডেমি অঙ্গনে স্টল করেছে। এবার মেলা প্রাঙ্গণে শিশুদের খেলাধুলার জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্রেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এবার মেলায় রয়েছে দু’টি লেখক কুঞ্জ।বইমেলা ১ ফেব্র“য়ারি থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্র“য়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। ২ ফেব্র“য়ারি থেকে ২৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার।
প্রতিবারের মতো এবারও মেলা প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হবে আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিস্মৃতপ্রায় বিশিষ্ট বাঙালি মনীষার জীবন ও কর্ম নিয়ে হবে এ আলোচনা। এছাড়া, মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৪ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, সংগীত, সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। শিশুদের জন্য মাসব্যাপী এ মেলায় এবার ৪ দিন শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। বইমেলার পাশাপাশি চারদিনের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে এসেছেন আর্ন্তজাতিক মানের বিদেশি লেখকরা। তারাও থাকছেন মেলার বিভিন্ন আয়োজনে। এবার ১০টি দেশের মোট ৪২ জন বিদেশি লেখককে বইমেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বইমেলায় আসা মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুরো মেলা প্রাঙ্গণে এবার থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তিনটি কন্ট্রোল রুম। এর মধ্যে দু’টি পুলিশ সদস্যদের জন্য ও একটি র্যাব সদস্যদের জন্য। মেলা প্রাঙ্গণে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়, সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য রাখা হয়েছে। ৫০ সদস্য বিশিষ্ট একটি আনসার টিমও মেলায় নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। পুরো মেলায় সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থানে মোট ৭০টি সিসি ক্যামেরার লাগানো হয়েছে।