দৈনিকবার্তা- ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি: সারাদেশের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা টানা হরতাল-অবরোধে নাজুক হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৬০% পণ্য সরবরাহ কমেছে কারওয়ান বাজারের পাইকারি আরতেই। পাশাপাশি পাইকার না থাকায় কমে গেছে বিক্রিও।
এ অবস্থা চলতে থাকলে পথে বসতে হবে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। এদিকে, পাইকারি বাজারে দাম কম হলেও খুচরা বাজারে শাকসবজি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।আরতদারদের দাবি, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি দিনে গড়ে ৫ লাখ টাকার লেনদেন হলেও এখন তা নেমে এসেছে দুই লাখেরও নিচে। আবার হরতাল-অবরোধের কারণে আরতে ঢাকার বাইরের পাইকারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিক্রি হচ্ছে সব পণ্য, আরতে পঁচে নষ্ট হচ্ছে তা।তবে খুচরা বাজারে চিত্র আবার ভিন্ন। ট্র্যাক থেকে নেমে কয়েক গজ দুরে খুচরা বাজারে এসব সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। টানা অবরোধের মধ্যে পাইকারি বাজারে রকমভেদে সবজিসহ অন্যান্য কাঁচা পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক দাবি করা হলেও দামের বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে খুচরা ক্রেতাদের।ক্রেতাদের অভিযোগ, সবজির ভরা মৌসুমে দাম যা হওয়া উচিত তার চেয়েও বেশি এবার। আর অবরোধের কারণে পরিবহনে বাড়তি খরচ পড়লেও দাম আছে আগের মতোই, দাবি বিক্রেতাদের। নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে গত ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করার জন্য গুলশানের কার্যালয় থেকে বের হতে না পেরে সারা দেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সবজি পরিবহন করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধের আগে যেখানে পণ্য পরিবহনে ট্রাক ভাড়া পড়ত ১৫ হাজার টাকা, সেখানে এখন বাড়তি গুণতে হচ্ছে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা।তবে পুলিশি পাহারায় পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করায় এই ভাড়া খানিকটা কমে এসেছে বলেও জানালেন তারা। ট্রাক চালক শরীফুল ইসলাম জানান, রাজশাহী থেকে আগে ১৮-২০ হাজার টাকায় ঢাকায় পণ্য আনার জন্য ভাড়া নিতেন তিনি। অবরোধের কারণে এখন সে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনে কিছু কিছু সবজির দাম কমেছে। আবার কয়েকটির দাম বেড়েছে। কিছুদিন আগে ২৫ টাকা কেজি দরে টমেটো বিকোলেও সরবরাহ বাড়ায় তা এখন ২২ টাকা। সাদা বেগুণের পাল্লা ১৫০ টাকা দরে কেজিতে পড়ছে ৩০ টাকা।পাইকারি বিক্রেতা হিরন আলী জানান, লাল বেগুণ পাল্লা ২০০ টাকা দরে কেজি ৪০ টাকা এবং লম্বা বেগুনের পাল্লা ১২৫ টাকা দরে প্রতি কেজির দাম হয়েছে ২৫-৩০ টাকা, যা ১০ দিন আগে ১৮-২০ টাকা ছিল।এছাড়া দেশি পেঁয়াজের পাল্লা ১৫০ টাকা দরে ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের পাল্লা ১৮০ টাকা দরে ৩৬ টাকা ও হাইব্রিড মরিচ ১২০ টাকা পাল্লা হিসেবে কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৪ টাকায়। মৌসুমের শেষভাগ হওয়ায় ফুলকপির সরবরাহ কম থাকায় দাম কিছুটা বেড়েছে। পাইকারি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে ফুলকপি ৬-৮ টাকায় বিক্রি হলেও এখন মৌসুম শেষ হওয়ার কারণে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়।অবশ্য কারওয়ান বাজার থেকে অল্প দূরে হাতিরপুল কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে টমেটোর দর সেখানে দোকানভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি।
এছাড়া ফুলকপি প্রতি পিস ২০ টাকা, আলু ১৫ থেকে ২০ টাকা, কাচা মরিচ ৪০-৫০ টাকা, পেঁয়াজ ৩৫ টাকা, বেগুণ ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।সবজি বিক্রেতা রাশেদুল বলেন, অবরোধের কারণে মাল কম আসায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে।বাজারের পাশাপাশি ভ্যানেও মিলছে কাঁচাসবজি। রকমভেদে এসব সবজির দামও তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে টমেটো ২৫ থেকে ৩০ টাকা, ফুলকপি ১৫ টাকা, আলু ১৫ থেকে ২০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০ টাকা, পেঁয়াজ ৩৫ টাকা, বেগুণ ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে শুক্রবার। বিক্রেতা রাশেদুল জানান, এ পণ্যগুলো অবরোধের আগে বিক্রি হত যথাক্রমে ২০ টাকা, ১০ টাকা, ১৫ টাকা, ৩০ টাকা, ৩০ টাকা, ১৫ টাকা কেজি দরে।দাম বাড়ার সত্যতা মিলল হাতিরপুল সবজির বাজারের নিয়মিত ক্রেতা ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা মঞ্জুর আহমেদের কথায়ও।তার দাবি, প্রায় সব সবজিতেই প্রতিকেজিতে ২ থেকে ৬ টাকা করে বাড়তি গুণতে হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা অবরোধে পণ্য কম আসছে কারণ দেখিয়ে বাড়তি টাকা চাচ্ছেন। হাতিরপুলে বাজারে আসা আরেক ক্রেতা মাহমুদা বানু জানালেন, কাঁচা বাজারে সবজির দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে। বিক্রেতারা পরিবহনে বাড়তি খরচ পড়ার কথা বলে অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন বলেও জানান তিনি।
পরিবহন খরচ যখন পণ্যমূল্যের নিয়ন্ত্রক, তখন ট্রাক মালিক ও চালকরা বলছেন- জীবনঝুঁকির কথা। ট্রাক চালক শরীফুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পুলিশ পাহারার পরও কেন পরিবহনে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। জবাবে তিনি বলেন, জানের রিস্ক নিয়া ট্রাক চালায়ে আসতে হয়। পেটের দায়ে চালাই। তাই টাকা বেশি নিতে হয়। অবরোধ শুরুর পর পর ৩০ হাজার টাকা নিতাম। এখন পুলিশ পাহারার কারণে রেট কমিয়ে দিয়েছি। তিনি জানান, সাতদিন আগে পণ্য পরিবহনের সময় তার ট্রাকের মালিক রেজাউল হকেরই অন্য একটি ট্রাকে হামলা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে পেট্রোল বোমা হামলায় ওই ট্রাকের চালক আবু বকর সিদ্দিকের মুখ, হাত ঝলসে গেছে। এখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
আর ট্রাক মালিক রেজাউল হক সহজ স্বীকারোক্তি: অবরোধে ট্রাক বের করায় তিনি ভাড়া বেশি পাচ্ছেন। এছাড়া ক্ষতি হলে সরকার গাড়ির ক্ষতিপূরণ দেবে বলেছে। তাই তিনি পণ্য পরিবহন চালু রেখেছেন।এসব বিষয়ে কথা হয় কারওয়ান বাজার ২নং কাঁচামাল আড়ৎ ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সেক্রেটারি আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “অবরোধে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। রাস্তায় ট্রাকে বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। সবার ভিতর তাই ভয় কাজ করছে। নিজের জীবনের ঝুকিঁ নিয়ে পণ্য পরিবহন করায় ভাড়া বেশি নিচ্ছে মালিকরা। ফলে কিছু পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। পুলিশ পাহারার কারণে পণ্য সরবরাহে সুবিধা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কোনো স্থায়ী সামাধান নয়। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে আসতে না পারলে পুলিশ কতটুকু প্রটেকশন দিতে পারবে!একইসঙ্গে বাজারে পাইকারি ক্রেতার সংখ্যাও কম বলে দাবি করেন আবদুল মান্নান।
তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, পাবনা এরকম নানান জায়গা থেকে পাইকারি ক্রেতা কম আসছে। ক্রেতা কম থাকায় পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়েনি। ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সবার প্রশ্ন আর কতদিন চলবে এ অস্থিরতা। কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে নিত্য পণ্যের বাজার।এদিকে, মেহেরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে ৩ হাজার ৮০০ পিস ফুলকপি নিয়ে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইকবাল কৃষকের কাছ থেকে প্রতি পিস ফুলকপি কিনেছেন ৪ টাকা করে, প্রতি পিসের পরিবহন ব্যয় পড়েছে ৫ টাকা ৭০ পয়সা আর অন্যান্য খরচ ৩ হাজার টাকা।সব মিলিয়ে প্রতি পিস ফুলকপিতে তারা ব্যয় হয়েছে ১০ টাকার ওপরে। কিন্তু বিক্রি করছেন মাত্র চার টাকা দরে।