দৈনিকবার্তা- ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি: তত্ত্বাবধায়কসরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, আমাদের দেশে সব নির্দেশ ঘুরেফিরে একই জায়গা থেকে আসছে৷ পুরো কাঠামো এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যেন সব সিদ্ধান্ত এককেন্দ্রিক ভাবে হচ্ছে,যা গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷বৃহস্পতিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অ:য়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল এ কথা বলেন৷ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারের টিআইবির কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়৷
সুলতানা কামাল বলেন, সিএজি কার্যালয় নিরীক্ষার জন্য এখতিয়ারভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান৷ এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না৷ এদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের সমস্যা বিরাজমান বলেও মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান, শাসন কোনো না কোনোভাবে এক কেন্দ্রিকতার মধ্যে থাকছে৷ নিরীক্ষণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ নেই৷ নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবিরের সংস্কৃতি মহামারীর মতো হয়ে গেছে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি না করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে সুশাসন টওতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন৷
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের আওতায় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা থাকলেও প্রায়োগিক কাজে সেটি ব্যাহত হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র দেখা যায়৷ ৬ বছর ধরে নিরীক্ষা আইন খসড়া হয়ে আছে৷ কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত অনুমোদিত হচ্ছে না৷ যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন৷ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ কামনা করছি৷সংবাদ সম্মেলনে একটি গবেষণা টওতিবেদন উপস্থাপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়কে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়৷ বাজেট, নিয়োগ, শিক্ষা সংক্রান্ত ছুটি, পদোন্নতি, নিয়মাবলী, আইনগত বিষয় ও সরকারি ক্রয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওপর নিভর্রশীলতা থাকায় সাংবিধানিক সংস্থাটি স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম নয়৷ পূর্বের তুলনায় বাজেট, অডিট ইউনিট এবং সরকারের জনবলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সিএজির প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি না পাওয়া, ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রামের জনবল দ্বারাই বর্তমান কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে৷
অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদ রয়েছে ৫০০টি৷ মাত্র ২ হাজার ৫৬৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা সরকারের প্রায় ৩০ হাজার সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নিরীক্ষা টওতিবেদন তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয় ও অনেক প্রতিবেদনে ভুল থাকে৷ এছাড়া জবাবদিহিতার সমস্যা ও তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়াও সচল নয়৷
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগ প্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে৷ এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র প্রতিবেদনে উঠে আসে৷
সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিটের নিকট থেকে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে যার পরিমাণ কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত৷ ঘুষের পরিমাণ নিভর্র করে অডিট ইউনিটের বাজেটের পরিমাণের ওপর৷ এছাড়া তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কমর্রত থাকা, অতিরিক্ত অর্থ আয়ের সুযোগ সম্পন্ন বিভিন্ন টওতিষ্ঠা যেমন- বন্ডেড ওয়ার হাউজ, ডিফেন্স অডিটের পূর্ত সংক্রান্ত, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল নিরীক্ষা করার জন্য ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি৷
মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে৷
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন- উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান৷ বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক টওতিষ্ঠান মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির চিত্র’ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ৷ এক গবেষণা প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, এ কার্যালয়ে নিয়োগ থেকে শুরু করে আপত্তি নিষ্পত্তি পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে চার-পাঁচ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে৷ একজন কর্মচারী নিয়োগেও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতির তদবির চলে সেখানে৷
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রভাবে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না৷ দুর্নীতি সনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে সিএজি নিজেই নিয়ন্ত্রণহীন হড়ে পড়েছে৷
মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগ প্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণে ঊধর্্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে৷সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিট থেকে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ টিআইবি বলছে, এই ঘুষের পরিমাণ নিভর্র করে অডিট ইউনিটের বাজেটের ওপর৷
এছাড়া পছন্দমত নিরীক্ষা, পূর্ত অধিদপ্তরের নিরীক্ষা, সিভিল অডিট, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট, বাণিজ্যিক অডিট, প্রতিরক্ষা অডিট, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি, ডাক-তার অডিট ও দীর্ঘদিনের পুরনো আপত্তি নিষ্পত্তিতে সিএজি কার্যাতলয়ে সর্বনিম্ন ৪-৫ হাজার টাকা থেকে ওেদড় লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলে ধরেছে টিআইবি৷
এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন,ক্ষেত্র বিশেষে সিএজি নিয়োগে দদলীয় রাজনৈতিক বিবেচনাকে\’ প্রাধান্য দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে৷
“সিএজি- তে একজন কর্মচারী নিয়োগে ৬ জন মন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির এক সভাপতি, সংসদ সদস্য, পিএসসির সদস্যসহ সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতার তদবির-চাপ প্রয়োগ হয়েছে৷ বলা যায়- যারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে৷ইফতেখারুজ্জমান বলেন, সিএজি কার্যালয়ে দুর্নীতির যে চিত্র- তা অগ্রহণযোগ্য৷ যে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরবে তাতেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতি চলছে৷ এটি প্রতিকার করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৩ সালের মার্চ থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪০টি সরকারি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে৷
এর আগে ২০০২ ও ২০১২ সালেও সিএজি কার্যালয় নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিআইবি৷দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধার ঘাটতি; নিরীক্ষা প্রতিবেদনের দীর্ঘসূত্রতা, সিএজির কাজের জবাবদিহিতা কৌশল না থাকা এবং তথ্যপ্রকাশ প্রক্রিয়া সচল না থাকাকে এ প্রতিষ্ঠানের ‘অভন্তরীণ চ্যালেঞ্জ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, গত বছর নভেম্বরে প্রথমবারের মতো সিএজি প্রতিবেদনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল, যা যথেষ্ট নয়৷ এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে৷পরিস্থিতির উত্তরণে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী ২০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি৷এর মধ্যে অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনা করে আইন-বিধি-অর্গানোগ্রাম অনুমোদন, সিএজি কার্যালয়কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সমান মর্যাদা দেওয়া, বাজেট-নিয়োগে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়া, জনবল বাড়িয়ে নিয়মানুবর্তী নিরীক্ষা চালুর সুপারিশও রয়েছে৷