দৈনিকবার্তা- ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি: অর্ধযুগ পর মাতৃভূমিতে ফিরলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো৷ তবে জীবিত নয় মৃত৷মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে কোকোর মরদেহ বহনকারী মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ ১০২ ফ্লাইটটি শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে৷
টানা ছয় বছর পর দেশে ফিরলেন বেগম খালেদা জিয়ার নাড়িছেঁড়া ধন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো৷ কিন্তু সে দেহ প্রাণহীন৷ শোকে পাথর বেগম জিয়া সন্তানের মুখ ধরে গুমরে কেঁদে উঠলেন, অশ্রুসিক্ত চোখে মোনাজাত করলেন এবং জানালেন শেষ বিদায়৷মঙ্গলবার বেলা ১টা ৪০ মিনিটে কোকোর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে৷ ১টা ৪৮ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স থেকে মরদেহ নামানো হয়৷ সোয়া ২টায় ছেলেকে শেষ দেখা দেখতে নিচে নামেন খালেদা জিয়া৷ এর আগে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে কোকোর মরদেহ বহনকারী মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ ১০২ ফ্লাইটটি শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে৷
লাশের সঙ্গে ছিলেন কোকোর স্ত্রী ও দুই মেয়ে, মামা শামীম এস্কান্দার ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু৷বিমানবন্দরে কোকোর মরদেহ গ্রহণ করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ এবং আনর্্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক গিয়াস কাদের চৌধুরী৷
ঢাকায় পৌঁছার পর কোকোর মরদেহ নেয়া হয় সরাসরি বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে৷ সেখান থেকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে নেয়া হয় মরদেহ৷ সেখানে বাদ আসর অনুষ্ঠিত হয় নামাজে জানাজা৷ বিকেলে বনানীর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে৷
শনিবার বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মালয়েশিয়ায় মারা যান কোকো৷ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ হাসপাতালে নেয়ার পথেই তার মৃতু্য ঘটে৷মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন কোকো৷ গত শনিবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৫ বছরে মারা যান তিনি৷
গত ওয়ান ইলেভেনের সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেনানিবাসের বাড়ি থেকে মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্রেপ্তার হন আরাফাত রহমান কোকো৷ এর পর ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই তত্কালীন সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পাওয়ার পর চিকিত্সার জন্য থাইল্যান্ড যান তিনি৷ এরপর দেশে না ফিরে তিনি মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান৷
২০ কোটি টাকার বেশি অর্থ সিঙ্গাপুরে পাচারে অভিযোগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ মানিলন্ডারিং আইনে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)৷ ২০১১ সালের ২৩ জুন আদালত এ মামলায় কোকোকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন৷ ওই মামলার রায়ে তাকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানার আদেশও দেন বিচারক৷ আওয়ামী লীগ সরকার সিঙ্গাপুর থেকে কোকোর পাচার করা অথের্র একটা অংশ দেশে ফিরিয়ে এনেছে৷জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর ফাঁকির অভিযোগে কোকোর বিরুদ্ধে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আরেকটি মামলা করে৷ এছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কোকোর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দু’টি চাঁদাবাজির মামলা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক একটি মামলা করে৷ আর সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপের মামলায় বড়ভাই তারেক রহমানের সঙ্গে এবং গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোকোও আসামি৷ এসব মামলার কারণে কোকো বিদেশে অবস্থান করছিলেন৷ মাঝেমধ্যে মাকে দেখতে উদগ্রীব হতেন কোকো৷ ফিরে আসতে চাইতেন মায়ের কাছে, ঢাকায়৷ দেশে ফিরলেই তাকে কারাবন্দি হতে হবে- এ জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে আসতে দেননি৷ কিন্তু এবার আর আটকে রাখতে পারলেন না৷ কোকো ফিরেই এলেন মাতৃভূমিতে, লাশ হয়ে৷
মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছানোর পর আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ নেওয়া হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে, তার মা খালেদা জিয়ার সামনে৷ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছায় কোকোর কফিন৷ এরপর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তার কফিন নেওয়া হয় গুলশানে৷
একই ফ্লাইটে কোকোর স্ত্রী, দুই মেয়ে, মামা শামীম এস্কান্দার এবং খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুও ঢাকায় আসেন৷অ্যাম্বুলেন্সটি গুলশান কার্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকানো হয় বেলা পৌনে ২টার দিকে৷ এরপর নেতাকর্মীরা ধরাধরি করে খয়েরি রঙের কফিনটি নিচ তলার একটি কক্ষে নিয়ে রাখেনকফিন খোলার পর একটি গিলাফ দিয়ে কোকোর মরদেহ ঢেকে দেওয়া হয় এবং তার স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি দুই মেয়ে জাহিয়া ও জাইসাকে নিয়ে উপরে যান, যেখানে অপেক্ষা করছিলেন পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়া৷ কিছুক্ষণ পর খালেদা জিয়ার দুই ভাই সাঈদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী দুই পাশ থেকে ধরে অশ্রুসিক্ত খালেদা জিয়াকে নিচে নামিয়ে আনেন৷
খালেদার দুই ছোট ভাইয়ের পরিবারের সদস্য, বড় ছেলে তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবালমান্দ বানু, জোবাইদার বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দু এবং কোকোর শ্বশুড়বাড়ির লোকজনও সেখানে রয়েছেন৷ওই কক্ষে আরবি হরফে লেখা একটি ব্যানার টানানো হয়েছে৷ পাশের কক্ষে জাতীয়তাবাদী উলামা দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা সেলিম রেজা, প্রচারনা ও প্রকাশনা সম্পাদক মাওলানা দ্বীন মোহাম্মদ কাশেমীর নেতৃত্বে সকাল থেকে কোরআন তেলাওয়াত চলছে৷
কোকোকে শেষবার দেখতে কয়েক হাজার নেতা-কর্মী গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের প্রবেশের পথ ও কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছেন৷ তবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও আত্মীয় স্বজন ছাড়া কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷ বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস অপেক্ষমাণ নেতাকর্মীদের জানাজায় অংশ নিতে বায়তুল মোকাররমে যাওয়ার অনুরোধ করেন৷
তিনি বলেন, জালিম সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বায়তুল মোকাররমে কোকোর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে৷ নেতাকর্মীদের সেদিকে যাওয়ার অনুরোধ করছি৷এর আগে সকালে মালদ্বীপ ও ভুটানের কূটনীতিকরা গুলশান কার্যালয়ে এসে আরাফাত রহমান কোকোর জন্য রাখা শোকবইয়ে সই করেন৷গত শনিবার দুপুরে হৃদরোগে মারা যান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো, যিনি মুদ্রাপাচারের একটি মামলায় সাজা নিয়ে মালয়েশিয়ায় ছিলেন৷
বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার আরাফাত ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই তখনকার কর্তৃপক্ষের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে চিকিত্সার জন্য থাইল্যান্ডে যান৷সেখান থেকে তিনি মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান৷গুলশানের কার্যালয়ে স্বজনদের শেষ দেখা ও শ্রদ্ধা জানানোর পর বিকাল ৪টায় জানাজার জন্য কোকোর মরদেহ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে নেওয়া হয়৷ কোকোকে বনানীতে সামরিক কবরস্থানে দাফনের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে অনুমতিও চাওয়া হলেও সেখানে অনুমতি মেলেনি বলে জানা গেছে৷ পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাকে বনানী কবরস্থানে দাফনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে৷
আরাফাত রহমান কোকোর প্রতি সন্মান জানাতে সোমবার থেকে তিন দিনের শোক পালন করছে বিএনপি৷ বিএনপির কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার পাশাপাশি কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে৷ নেতা-কর্মীরা বুকে কালো ব্যাজ পরছেন৷এই তিনদিন সারা দেশের মসজিদে মসজিদে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিল চলছে৷ এছাড়া মঙ্গলবার সারা দেশে কোকোর গায়েবানা জানাজা পড়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা৷