দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি: জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোরতা প্রদর্শন করার সিদ্ধান্তে অটল সরকার৷ কঠোরতার প্রথম পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সরকারের দৃষ্টি এখন বিএনপির তৃণমূলে৷ কারণ বিএনপির অবরোধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন জেলাতেই নাশকতা হয়েছে বেশি৷ কঠোরতার পরবর্তী ধাপের ধকল যাবে বিএনপি জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর দিয়ে৷ সরকার তাদের নাশকতার নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ পরবর্তী সময়ে লন্ডন থেকে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া৷ সর্বশেষ বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করতে দলের অধিকাংশ নেতাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা ও বিএনপি নেতাদের দিয়ে নতুন দল গঠন করা৷ তবে কঠোরতার বাকি পদক্ষেপ সামনে রয়েছে৷ কঠোরতার প্রথম ধাপ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির যৌথ অভিযান, নাশকতা করার সময়ে হাতেনাতে ধরতে পারলে গুলির সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার৷
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিরা মনে করছেন চলমান কঠোরতায় ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে৷ পেট্রল দিয়ে মানুষ পোড়ানো আর নাশকতা দমনে সরকার জিরো টলারেন্স দেখাবে৷ সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র জানায়, কঠোরতার প্রথম পর্যায়ে রয়েছে সারাদেশে নাশকতাকারীদের ধর-পাকড়, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনা৷ এ পর্যায়ে তালিকাভুক্ত বিএনপির তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতার করা হবে৷ আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার দলের হাইকমান্ডের আস্থা হারিয়েছেন৷ তাই তার ভরসা এখন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ওপর৷ ইতিমধ্যেই বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূল নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিয়েছেন৷ জামায়াত তাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে নাশকতা পরিহার করে সেফ জোনে থাকতে৷
গত তিন দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকশ চিহ্নিত বিএনপি নেতা গ্রেফতার হয়েছেন৷ আতঙ্কে ঘরছাড়া বাকিরা৷ এ অবস্থায় বিএনপির নাশকতা দমনে সরকার অনেকটা সফল বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড৷ ইতিমধ্যে যারা বোমা ছুড়বে ও গাড়িতে আগুন দেবে, তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল৷ তিনি বলেন, পুরস্কারের মূল্য কত হবে, তা পরে জানানো হবে৷ গত মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে প্রতিমন্ত্রী এই পুরস্কারের ঘোষণা দেন৷ বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নতুন সিদ্ধান্ত হয়৷ নাশকতাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে যে পুরস্কার দেয়া হবে তার মূল্যও নির্ধারিত করা হয় ৷ আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, সরকারের প্রথম দফা কঠোরতাতেই বিএনপি অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে৷
এরপর প্রয়োজনে দ্বিতীয় দফায় খালেদা জিয়াকে আটক অথবা বলপ্রয়োগ করে কম্বাইন মিলিটারি হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হতে পারে৷গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এভাবে ফোর্স করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল৷ এজন্য সরকার অনেক আগে থেকেই খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে এমন খবর রাজনীতির মাঠে ছেড়ে দিয়ে বিষয়টিকে অনেকটা স্বাভাবিক করে রেখেছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন৷
সরকারের তথ্য অধিদফতরের এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সরকারের দ্বিতীয় কঠোরতার পদক্ষেপ খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, সামপ্রতিক অবরোধে জ্বালাও- পোড়াও এবং মানুষ হত্যার ঘটনার জন্য খালেদা জিয়া দায়ী৷ তিনি বলেন, প্রকাশ্যে ঘোষণা ও উসকানি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা, জনগণের জানমাল ধ্বংস করার জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হবে না কেন?
এ সময় আগামী মাসে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে সব ধরনের কর্মসূচি স্থগিত রাখার জন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে৷ এতে বাধা দেয়া হলে প্রশাসন কঠোর থেকে কঠোরতর পদক্ষেপ নেবে৷সূত্র জানায়, সরকারের দ্বিতীয় পদক্ষেপে বিএনপির কেন্দ্রীয় সব নেতা যারা রাজনীতির মাঠে অ্যাকটিভ তাদের আটক করে বিভিন্ন নাশকতা ও হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে৷
সরকার ও আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের একাধিক সূত্র জানায়, এরপরও বিএনপি নাশকতার পথ না ছাড়লে খালেদা জিয়ার দুর্বলতার জায়গা’ হিসেবে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন মামলায় সাজাভোগের ব্যবস্থা করা হবে৷ এটা হবে সরকারের কঠোরতার তৃতীয় মাত্রা৷ ইতিমধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া চিঠিটি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে৷ সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, তারেককে ফেরত পাঠাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডের কাছে লেখা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর চিঠি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে৷ এর আগে গত বুধবার লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কাছে চিঠিটি পাঠানো হয়৷ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে চিঠিটি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়৷
এর আগে জামিনে মুক্তি পেয়ে তারেক রহমান চিকিত্সার জন্য ২০০৮ সালে লন্ডনে যান৷ এর পর থেকে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন৷ তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে৷ সরকারের সূত্র জানায়, তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থানের সুযোগ নিয়ে এমন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রয়েছেন, যা বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি স্বার্থের পরিপন্থী৷ আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকায় তারেক রহমানের বক্তৃতা-বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে হাইকোর্ট গত ৭ জানুয়ারি আদেশ দেন৷
এতেও বিএনপিকে নিবৃত্ত করতে না পারলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করা হবে৷ পরে বিএনপির মধ্যমসারির নেতাদের বড় একটি অংশকে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙানো হতে পারে৷ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা মানবকন্ঠকে বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাঙনের মুখে পড়তে পারে বিএনপি৷ ইতিমধ্যেই তার আলামত বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) পেয়েছেন৷সরকারের একাধিক শীর্ষ ব্যক্তি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সরকার৷ আপাতত বিএনপির কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে৷ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মানবকন্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তির আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে৷ দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার গৃহীত ব্যবস্থা ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে৷ জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে নাশকতার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী তার জিরো টলারেন্সের কথা ইতিমধ্যেই বলেছেন৷
সংশ্লিষ্টদের দাবি, বিএনপির কর্মসূচির ওপর নির্ভর করবে সরকারের কঠোরতা৷ সহিংসতার পথ ছেড়ে বিএনপি যদি সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসে, সরকারও দমনপীড়ন নীতি পরিহার করে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে৷ আর বিএনপি যদি জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি বহাল রাখে এক্ষেত্রে জনস্বার্থে সরকার আরো কঠোর হবে৷ ইতিমধ্যে বিএনপির লাগাতার অবরোধে চলমান সহিংসতার লাগাম টেনে ধরতে ৭ দিনের মিশনের অংশ হিসেবে সপ্তাহের প্রথম দিনের শুরু থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর চিরুনি অভিযান (কম্বিং অপারেশন)৷
ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, কানসাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, শেরপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, রাজশাহী, বরিশাল ও চট্টগ্রামসহ দেশের যে ২৭টি জেলায় কয়েক দিনে সবচেয়ে বেশি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ওই জেলাগুলোতে অভিযান পরিচালনায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ ওইসব এলাকায় অভিযানের সময় রাজনৈতিক দুবর্ৃত্ত ও ভাড়াটে পিকেটাররা যাতে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পালাতে না পারে এ জন্য ২৪ ঘন্টা সড়ক, নৌ ও রেলপথে বিশেষ পাহারা বসানো হবে৷ খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ অভিযানের তদারকি করবে৷ এরই মধ্যে সন্দেহভাজন নাশকতাকারী, তাদের অথের্র জোগানদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের তালিকা যৌথবাহিনীর হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, অবরোধের নামে নাশকতা ও মানুষ হত্যাকারীদের ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ যারা এসব মামলার আসামি, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে৷ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ২৪ ঘন্টা পরিস্থিতি মোকাবিলায় রয়েছে৷ পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে সব জায়গায় মানুষের জানমাল নিরাপদ রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করছে৷
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ছাত্রদল নেতা আকরামসহ যারা পেট্রলবোমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে এবং তাদের স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপি জড়িত৷ তাদের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশেই এমন কর্মকাণ্ড হচ্ছে৷ অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে৷