দৈনিকবার্তা-ঠাকুরগাঁও, ১৬ জানুয়ারি: ‘হামারা কি দেশের জন্য ইজ্জত-সম্মান দেইনি? এগুলার কি কুন দাম নাই৷ সকাল হলেই অভাবে পড়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করি৷ যদি কাজ না পাই, মানুষের কাছে চাহে মাঙ্গে (চেয়ে নিয়ে) খাই৷ বীরাঙ্গনা বলে মানুষ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে৷ এখন আমার কি উপায় কিছু হবে?’ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নিয়ানপুর গ্রামের ষাটোধর্্ব বীরাঙ্গনা মোকলেছা বেগম৷
শুধু মোকলেছা নন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোকলেছার চার বোনসহ অসংখ্য নারীকে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল পাকিসত্মান সেনাবাহিনীসহ এ দেশীয় রাজাকার-আলবদররা৷ যাদের মধ্যে রানীশংকৈলে এখনও বেঁেচ আছেন ২২ বীরাঙ্গনা৷ শুধুই কি অভাব, ভিক্ষা করেও জীবন চালাচ্ছেন অনেকে৷ অভাব-অনটনে জর্জরিত মোকলেছার ছোট বোন বুধি ২০০৫ সালে না ফেরার দেশে চলে গেলেও এখনও বাকি তিন বোন হাহাকার আর আতঙ্ক নিয়ে জীবন যাপন করছেন৷ যুদ্ধের পর আর বিয়ে হয়নি এক বোনেরও৷ এলাকাবাসী তাদের প্রায় দুই বছর একঘরে করে রাখলেও এখন সঙ্গী তাদের অপমান আর লাঞ্ছনা৷
রানীশংকৈল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিট কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম বলেন, \’এ এলাকায় অসংখ্য বীরাঙ্গনা রয়েছে৷ গত বছর স্থানীয় উদ্যোগে আমরা এলাকায় ঘুরে ঘুরে ৩৫ জন বীরাঙ্গনার তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম৷ তবে সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত যাছাই-বাছাই করে ২৪ জনকে সঠিক বলে মনে হয়েছে৷ তারা প্রত্যেকেই সমাজে অবহেলিত আর বঞ্চনার শিকার৷ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় তাদের কোনো খোঁজ না রাখলেও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত বছর বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে সস্মাননা দেওয়া হয়েছে৷\’
তথ্যানুসারে ২৪ বীরাঙ্গনা হলেন রাণীশংকৈল উপজেলার বলিদ্বারা গ্রামের টেপরি রানী; কেউটান গ্রামের ঝরনা রানী মুল, তীর্থবালা পাল; রাউতনগর গ্রামের আসমা বেগম, হাফেজা বেগম, মুনি কিস্কু, সীতা হেমব্রোম, সুবি বাসুগি, জবেদা বেওয়া, হনুফা বেওয়া, সাজেদা বেগম, রওশন বেওয়া; শিদলী গ্রামের নিহার রানী দৈবা; ফাড়াবাড়ি গ্রামের হাসিনা বেগম, হালিমা বেগম. ভারা গ্রামের চানমনি; লেহেম্বা গ্রামের ঝড়ূ বালা; পকম্বা গ্রামের নুরজাহান বেগম; পদমপুর গ্রামের হাসিনা বেগম; গোগর গ্রামের মালেকা বেগম; শামাডাঙ্গী গ্রামের জমেলা বেওয়া; নিয়ানপুর গ্রামের তিন বোন মালেকা বেগম, আমেনা বেগম ও মোকলেছা বেগম৷
বীরাঙ্গনা ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, রানীশংকৈল উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পড়ে থাকা এই বীর নারীদের সহযোগিতায় আজও সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি সংগঠন কেউ এগিয়ে আসেনি৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার পরপরই পাকিসত্মানি সেনারা ঢুকে পড়েছিল রানীশংকৈল উপজেলার প্রত্যনত্ম গ্রামগুলোতে৷ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে করেছে হত্যা, লুট আর ধর্ষণ৷ ৪২ বছর আগে রানীশংকৈলে হানাদার বাহিনীর এ ববর্রতার ঘটনা তখন স্থান করে নিয়েছিল বিশ্ব গণমাধ্যমেও৷ তখন এলাকার রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে উপজেলার দোশিয়া নয়াবসত্মি গ্রামের ৪ বোন মালেকা, আমেনা, মোখলেছা ও বুধিকে তুলে দিয়েছিল পাকিসত্মানি বাহিনীর হাতে৷ একটানা ৮ মাস তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় হানাদার বাহিনী৷
চার বোনের একজন মোখলেছা৷ ভিক্ষে করে চলছে তার সংসার৷ নিজের কোনো জায়গা-জমি না থাকায় থাকছেন উপজেলার তত্কালীন জমিদার টংকনাথের পুরনো ভাঙাচোরা ভবনের পাশর্্ববর্তী চৌধুরীপাড়া বসত্মিতে৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন হানাদার বাহিনীর হাতে, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও একইভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন সমাজের কাছে৷ জীবনের শেষ বেলায় আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই তার৷ চান শুধু সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্মান৷
মোখলেছা বলেন, \’আমাকে ও আমার দুই বোন বুধি আর মালেকাকে ৮ মাস রাজাকার আদিলুর বিশ্বাসের বাড়িতে আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো৷ আমাদের সঙ্গে কদমপুর গ্রামের হাসিনা আর ভান্ডারা গ্রামের চানমনিও ছিল৷ চানমনি সুন্দরী ছিল বলে তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বেশি হতো৷ প্রতিদিনই হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নানাভাবে নির্যাতন করত৷ নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে স্থানীয় মুক্তিবাহিনী পাকিসত্মান হানাদারদের সঙ্গে ছয় ঘন্টা যুদ্ধ করে আমাদের মুক্ত করে৷ বাড়ি ফেরার পর আমাকে ও আমার বোনদের অনেক অপমান আর তাচ্ছিল্য করে গ্রামবাসী৷ তারা আমাদের \’বেশ্যা\’ বলে অনেক দিন একঘরে করে রাখে৷ আমার বড় দুই বোন আমেনা আর মালেকা স্বাধীনতার পর কেউই আর সংসার করতে পারেনি৷ আমিও পারিনি সংসার পাততে৷ পাইনি স্বাভাবিক জীবন৷ আমার আরেক বোন বুধি ২০০৫ সালে বিনা চিকিত্সায় ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে৷ \’
বীরাঙ্গনা মোখলেছার বড় বোন মালেকার বয়স এখন ৭০৷ তার অবস্থা আরও করম্নণ৷ যুদ্ধের ডামাডোলের সময় বিয়ে হয়েছিল তার৷ বাপের বাড়িতে নাইয়র এসে হানাদারদের লালসার শিকার হতে হয় তাকে৷ স্বামী-সংসার হারিয়ে নীড়হারা পাখির মতো আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি৷
মোখলেছার বোন আমেনার বয়স এখন ৬৭৷ তিনি বলেন, \’একাত্তরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় রাজাকার মকবুল ও আদিলুর বিশ্বাসের সহায়তায় পাকিসত্মানি বাহিনী আমার তিন বোন মালেকা, মোকলেছা ও বুধিসহ আমাকে ধরে নিয়ে যায়৷ আমাকে আমার বাবার বাড়ি দোশিয়া নয়াবসত্মি থেকে ধরে নিয়ে তিন মাস ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে৷ তারা তখন আমার স্বামীকেও হত্যা করে৷ প্রতিদিন কয়েকবার করে নির্যাতন চালাত পাকিসত্মানি সেনারা৷ সবচেয়ে খারাপ লাগত আমাদের চার বোনকে একই সঙ্গে কয়েকজন মিলে যখন নির্যাতন করত৷ এ কষ্টের কথা ভাবলে চোখে পানি আসে৷ বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না৷ মনে হয় আত্মহত্যা করি৷ তাদের কথামতো কাজ না করলে খাবার পর্যনত্ম দিত না৷ পাকিসত্মানি বাহিনীর নির্যাতনে আমার গর্ভের একটি ছেলে সনত্মান মারা যায়৷ যা আমাকে এখনও কষ্ট দেয়৷ এতসব নির্যাতন-অত্যাচারের পরও ছোট বোনগুলোর দিক তাকিয়ে সব সহ্য করছিলাম৷ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সেখানকার এক পাঞ্জাবি হাবিলদারের সহায়তায় ওই ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গ্রামে ফিরে আসি৷\’
বলিদ্বারা গ্রামের টেপরি রানী৷ যুদ্ধের কিছুদিন আগে ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শিয়ালডাঙ্গী গ্রামের মাটাং রায়ের সঙ্গে৷ একাত্তরের মে মাসে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিসত্মানি সেনারা প্রথমে তাকে ধরে নিয়ে যায় শিয়ালডাঙ্গী ক্যাম্পে৷ সেখানে তারা তিন দিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর তাকে ছেড়ে দেয়৷ কিন্তু তখনও তার দুর্বিষহ জীবনের শেষ হয়নি৷ মাসখানেক পর ফের তিনি আটক হন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ১০-১২ বার শিয়ালডাঙ্গীসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে তাকে অসংখ্যবার নির্যাতন করে পাকিসত্মানি সেনারা৷
টেপরি রানী বলেন, \’পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাকিসত্মানি সেনা ও রাজাকাররা ইচ্ছামতো নির্যাতন করত৷ সবার কথা চিসত্মা করে সব মুখ বুজে সহ্য করেছি৷ আমি পাকিসত্মানি সেনাদের বারবার আমাকে মেরে ফেলার জন্য আকুতি করলেও তারা তা করেনি৷ আত্মহত্যা করে জীবন বিপন্ন করতে চাইনি৷ সংগ্রাম করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম৷ নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি৷\’ তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বলিদ্বারা গ্রামে আবার বসবাস শুরম্ন করি৷ কিন্তু নির্যাতিত হওয়ায় আমাদের পরিবারকে প্রায় দুই বছর একঘরে করে রাখে স্থানীয় লোকজন৷ আমাদের সঙ্গে কেউ লেনদেন করত না, কথা পর্যনত্ম বলত না৷ এরমধ্যে ১৯৭৩ সালে আমার স্বামী মাটাং রায় অসুখে মারা যান৷ তারপর থেকে আমার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছি৷ ছেলে সুধীর ভ্যানচালক৷ টেপরি রানীর দাবি, \’সুধীরের বড় মেয়ে (তার নাতনি) জনতা রায়কে যেন সরকার একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়৷\’ জনতা রায় এবার স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে৷
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঠাকুরগাঁও জেলা ইউনিটের কমান্ডার জীতেন্দ্র নাথ বলেন, \’বীরাঙ্গনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা৷ তারা স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন৷ আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা তাদের সন্মান জানাতে না পারলেও জনগণের মনে তাদের স্বীকৃতি সব সময় আছে৷ রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা জানানো উচিত৷ আশা করি, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের স্বীকৃতি দেবে৷\’