দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ জানুয়ারি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থনির্ভর হয়ে পড়ছে৷এ থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্ররাজনীতিকে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আদর্শিক ও গণমুখী করে তুলতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান৷
মঙ্গলবার বেলা পৌনে দুইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন৷ তিনি বলেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে অনেক বরেণ্য রাজনীতিবিদের৷ মূলত ছাত্ররাজনীতির পথ বেয়েই তাঁদের উত্থান ঘটেছে৷ নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে৷ তবে তা হতে হবে আদর্শিক ও জনকল্যাণমুখী৷
নিজেদের সময়ের ছাত্ররাজনীতির কথা বলতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাদের সবারই আদর্শ ছিল৷ সেই আদর্শ হলো দেশ ও জনগণের কল্যাণ সাধন৷ সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের কোনো স্থান ছিল না৷
তিনি সমাবর্তনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে ও মননে দেশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করতে বলেন৷ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বই পড়া, নিজ এলাকায় পাঠাগার তৈরি, দরিদ্র শিশুদের সহায়তা, রক্তদান ও বস্ত্রদানসহ মানবিক, সামজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি৷
১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা আবদুল হামিদ বাঙালির সেই সংগ্রামের অধ্যায়ে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ভূমিকার কথা আজকের স্নাতকদের মনে করিয়ে দেন৷রাষ্ট্রপতি বলেন, আজও তিনি ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নন, কেননা নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে বলেই তার বিশ্বাস৷
তবে তা হতে হবে আদর্শিক, জনকল্যাণমুখী৷ ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তাদের সকলেরই আদর্শ ছিল৷ সে আদর্শ হলো দেশ ও জনগণের কল্যাণ সাধন৷ সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কোনো স্থান ছিল না৷
বর্তমানে ছাত্র রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে সে আদশের্র অনুপস্থিতি আমাকে বেদনাহত করে, বলেন তিনি৷
জাতীয় সংসদে সাতবার কিশোরগঞ্জের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা এবং পরে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা হামিদের পর্যবেক্ষণ,দেশের ছাত্র রাজনীতি এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ নির্ভর হয়ে পড়েছে৷
এ থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্র রাজনীতিকে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আদর্শিক ও গণমুখী করে তুলতে আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাই৷রাষ্ট্রপতি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে অনেক বরেণ্য রাজনীতিবিদের৷ তারা মহান স্বাধীনতাসহ জাতীয় উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন৷ মূলত ছাত্র রাজনীতির পথ বেয়েই তাদের উত্থান ঘটেছে৷ তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ছাত্র রাজনীতির রয়েছে এক বিশাল সংযোগ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ার কথা উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, লেখাপড়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদেরও লেখাপড়ার পথ উন্মুক্ত ছিল৷ তবে তা ছিল সীমিত৷ ইংরেজ উপাচার্যের উত্সাহ ও উদ্যোগে শুরুতে স্বল্প সংখ্যক ছাত্রী নানা চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন৷ আমি আজ গর্বের সাথে বলতে পারছি যে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই ছাত্রী৷ নিঃসন্দেহে এটি আশাব্যঞ্জক৷
শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আজ নারীরা দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ শিক্ষা কার্যক্রমে সমভাবে অবদান রেখে চলেছেন৷ আমি তাদের অবদান ও ভূমিকাকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানাই৷
মাতৃভাষার অধিকার আদায়, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে বলিষ্ঠ ও সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শিক্ষা-গবেষণা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি৷
আজও গণতন্ত্র রক্ষা ও চর্চায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুড়ি নেই৷ তাই এই মহান বিদ্যাপীঠের স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য সারা জাতির সাথে আমিও গর্ব অনুভব করছি৷
সমাবর্তনে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, সমকালীন বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেকে অধিক যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে৷ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলায় সাহসী ও উদ্যোগী হতে হবে৷
মনে রাখতে হবে নিজেদের আত্মপরিচয়ের কথা, মাতৃতুল্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা৷ অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় দেশটির কথা৷ ভুললে চলবে না- তোমাদের সামান্যতম নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আমাদের বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে তত্কালীন পূর্ব বঙ্গে উচ্চশিক্ষার যে দাবি উঠেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই মাত্র ৮৭৭ জন ছাত্র, ৬০ জন শিক্ষক, তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল৷
শতকের পথে এগিয়ে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর আজ অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আমি জানতে পেরেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী, ১ হাজার ৮২৬ জন শিক্ষক, ১৯টি আবাসিক হল, চারটি হোস্টেল, ১৩টি অনুষদ এবং ৪৮টি গবেষণা কেন্দ্রের সমন্বয়ে দেশের সর্ববৃহত্ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থান করে নিয়েছে৷
এর আগে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে আচার্য কার্জন হলের সামনে থেকে শোভাযাত্রা করে সমাবর্তনস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে যান৷ জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া এ সমাবর্তন অনুষ্ঠান বেলা একটা ৫১ মিনিটে আবার জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়৷সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জেনেভাভিত্তিক মেধাস্বত্ব সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডবি্লওআইপিও) মহাপরিচালক ফ্রান্সিস গ্যারিকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি দেওয়া হয়৷
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমরা এখনো একুশ শতকের সব পর্যায়ের শিক্ষাকে বিজ্ঞানমুখী করে তুলতে পারিনি৷ আগামী ৫০ বছরে না হোক, অন্তত আগামী ২০ বছরে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী জাতীয় এবং কী পরিমাণ বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রয়োজন, সে রূপরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনায় এখনো প্রাধিকার লাভ করেনি৷
শিক্ষার্থীদের উপদেশ দিয়ে উপাচার্য বলেন, তোমরা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করো না, তোমাদের জাগ্রত সত্তায় এ বোধ যেন সব সময় সজাগ থাকে যে, তোমরা এ দেশের সম্পদ৷ জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি তোমাদের প্রতিজ্ঞা৷
সমাবর্তনে ২৯ জনকে স্বর্ণপদক, ৪২ জনকে পিএইডি,২০জনকে এমফিল, ৫৬৫ জনকে স্নাতকোত্তর এবং তিন হাজার ১৬০ জনকে স্নাতকসহ মোট ছয় হাজার ১০৪ জনকে বিভিন্ন ডিগ্রি প্রদান করা হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আবদুল হামিদ তার হাতে তুলে দেন সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি৷