দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১১ জানুয়ারি: রাজধানীর কাটাসুর পুলপাড়ের বটতলা বসত্মিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷ আগুনে এরই মধ্যে কয়েকশ’ কাচা ঘর পুড়ে গেছে৷ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে৷খানিক আগে যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল, তা নিভে গেছে৷ নিভে যাওয়ার খবর স্বস্তির হলেও সে আগুনের অভিশাপে শোকের মাতম চলছে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার পুলপাড় বস্তিতে৷ সর্বনাশা আগুন কেড়ে নিয়েছে অবুঝ এক শিশুর প্রাণ৷ ৪০ দোকান আর ৫০০ বসত-ঘরের সঙ্গে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে হাজার-লাখো স্বপ্নও৷
রোববার সকাল ৮টা ২৮ মিনিটে এ অগি্নকাণ্ডের সূত্রপাত হয়৷ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রধান কার্যালয়ের ডিউটি অফিসার শাহজাদী সুলতানা জানান, রোববার সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টায় কাটাসুরের (পুলপাড়) বটতলা বসত্মিতে আগুন লাগে৷খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০ টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে৷ তবে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি তাত্ক্ষণিকভাবে জানা যায়নি৷
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয়রাও কাজ করেছেন৷ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুনর বিসত্মৃতি নিয়ন্ত্রনে আনা হয়েছে৷সাবেক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামীলীগ যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷ ক্ষতিগ্রসত্মদের তিনি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷
আগুন নিয়ন্ত্রণে মোহাম্মদপুর, পলাশী,লালবাগ ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১১ ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যায়৷ স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে প্রায় দেড়ঘন্টা প্রচেষ্টার পর পৌনে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানান ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণকক্ষের জয়েন্ট ডিউটি অফিসার নাজমা আক্তার৷
ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসের কর্মী জসিমও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ক্ষয়ক্ষতি তাত্ক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি৷
তিনি বলেন, দুই ধরনের পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে৷ একটি আপদকালীন ও অপরটি স্থায়ী পুনর্বাসন৷ পরিবারগুলো যেন শীতে কষ্ট না পায় সেজন্য তাদের আপাতত আপদকালীন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সরকার৷ স্থায়ী পুনর্বাসনের বিষয়ে পরে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷আগুন লাগার কারণ বিষয়ে তিনি বলেন, কীভাবে আগুন লাগল, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি৷ তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে৷ আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি ঘরের গৃহকর্ত্রী মনোয়ারা বলেন, আগুনে আমার ঘরসহ অন্তত ৪০টি দোকান ও ৫০টি বাড়ি পুড়ে গেছে৷ এসব বাড়িতে প্রায় ৫০০ ঘর ছিল৷ আগুনে ফাতেমা নামে এক শিশুর মৃতু্য হয় বলে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন৷
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফাতেমা নামে ওই শিশুকে বাসায় ঘুমন্ত রেখে তার বড়বোনকে নিয়ে মা আসমা স্কুলে যান৷ কিন্তু অগি্নকাণ্ডের খবরে বাসায় ফিরে আর ফাতেমাকে জীবিত পাননি তারা৷মনোয়ারা জানান, তিন তলা একটি টং ঘর থেকে অগি্নকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বস্তির পূর্ব পার্শ্বের ঘরগুলো বেশি আগুনে পুড়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিম পাশ্বর্ের ঘরগুলোও৷
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরু পথ হওয়ায় বস্তিতে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে ফায়ার সার্ভিসকে বেশ বেগ পেতে হয়৷ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্ডের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেইন্যান্স) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পানির অভাবের কারণে বেশি বেগ পেতে হয়৷তিনি বলেন, এলাকার বাসাবাড়ি থেকে পানি কিনে কাজ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা৷ বস্তি এলাকায় প্রবেশের রাস্তা সরু৷ এ কারণে আমাদের ১১টি ইউনিট থাকলেও সবগুলো দিয়ে কাজ করতে পারিনি৷ আমার ফাতেমা নাই রে, আমার ফাতেমা কই গেছে রে! আর্মি-বিডিআর কেউ আমার ফাতেমার খবর দিতে পারে না রে, ফাতেমা পুইড়া কইলা হইয়া গেছে, অনেক বিচরাইছি (সন্ধান) রে, কোথাও পাই নাই রে৷
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার পুলপাড় বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে মারা যায় তিন বছর বয়সের ফাতেমা৷ সন্তান ফাতেমার ছবি হাতে নিয়ে এভাবেই শোকের মাতমে চারপাশ ভারী করে তুলছিলেন মা আসমা বেগম৷ রায়ের বাজার হ্যাবলা ম্যানেজারের বাসায় আসমার আহাজারি-বিলাপে সান্ত্বনা দিতে যাওয়া লোকজনকেও চোখের পানি মুছতে দেখা যায়৷সকাল ৭টার সময় আসমা বেগম তার বড় মেয়ে জয়নবকে নিকটস্থ জাফরাবাদ আদর্শবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিতে যান৷ যাওয়ার আগে তালাবদ্ধ ঘরে ছোট শিশু ফাতেমাকে কম্বলের নিচে ঘুম পাড়িয়ে দেন৷ আগুন লাগার খবরে বস্তিতে ছুটে আসেন৷ কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার বসত ঘর, সঙ্গে কলিজার টুকরো ফাতেমাও৷ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফাতেমা যে ঘরে ছিল তার পাশের ঘর থেকেই অগি্নকাণ্ডের সূত্রপাত হয়৷ শুধু ফাতেমা পুড়ে ছাই হয়নি, তার মতো আরও কয়েকজন শিশুকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷
ফাতেমার বাবা আব্দুল জয়নাল রিকশাচালক৷ কাক ডাকা ভোরেই তিনি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন৷ তার বাড়ি শরীয়তপুর সদরে৷বারবার ফাতেমার কথা মনে করে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আসমা৷ রঙিন ফ্রেমে বেঁধে রাখা বড় মেয়ে জয়নব ও ছোট মেয়ে ফাতেমার ছবি দেখিয়ে আহাজারি করে বলেন, আমি এইডা কী করলাম, কির লেইগা ফাতেমারে স্কুলে নিলাম না৷ স্কুলে নিলে মাইয়াডা বাঁইচা যাইতো৷ আমার মাইয়ার জোড় বেজোড় হয়ে গেল রে! পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে যাওয়া মেয়ের শরীরটা বুকে জড়িয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বাবাও, খোদা আমারে নিয়া যাইতা৷ আমার ফাতেমাডারে ক্যান নিলা রে৷