দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৬ জানুয়ারি – দুবাই থেকে ফিরেঃ নিতান্ত কর্মক্ষেত্রের দায়িত্তের কারণে অনেক সময় দেশের বাইরে যেতেই হয় আমাকে । এমনিতেই দেশ ভ্রমণ আমার পেসার চাইতে নেশাই বেশী। পৃথিবীর অনেক দেশই ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে আমার। অনেক ভাবে আকৃষ্ট হয়েছি অনেক কিছু দেখে। এই যে কিছুদিন আগেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল খেলার আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলাম স্বপ্নের দেশ ব্রাজিলে । সাম্বা ড্যান্সক্ষেত স্বপ্নিল দেশ ও আমাকে ততোটুক আকৃষ্ট করতে পারেনি যতটুকু আকৃষ্ট করে সেই মরুময় বালুকার চাদরে ঘেরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিলোত্তমা নগর দুবাই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আর পারবেই বা কি করে? দুবাই যখন তার যৌবনে পদার্পণ করছে ঠিক তখন পেটের তাড়নায় প্রথমই আমাকে আসতে হয়েছিল এই দেশে। নিজের এবং দুবাই এর যৌবনের সংমিশ্রণে জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সময়টুকু অতিবাহিত করি সেখানে। তাই মাতৃভূমির মতো অনেকটা নাড়ীর টান রয়েছে আমার এ দেশটির প্রতি।
সাংবাদিকতার পেশা নিয়ে এবার আবুধাবীতে গিয়েছিলাম একটা সেমিনারে যোগ দিতে। আর সেদিন থেকেই চেষ্টা করছি আমিরাত নিয়ে কিছু একটা লিখবো; লিখবো রাজধানী আবুধাবীকে নিয়ে, লিখবো দুবাই এর বিশ্বের সর্ব বৃহৎ অট্টালিকা বুরজ খালিফা, পাম জুমেইরা, দ্য ওয়ার্ল্ড, মিরাকেল গার্ডেন ছাড়াও আরো অনেক কিছু নিয়ে। সেখানে অনেক কিছু আছে যার প্রতিটি আইকন নিয়ে লেখা যায় দশ দশটি পাতা। ল্যান্ডমার্কের প্রতিবেদন লেখার পরিকল্পনা করতে না করতে মাথায় এলো অন্য ভূত। কাল রাত কিছু পুরনো বন্ধুদের সাথে বসেছিলাম, আড্ডায় বসে যা শুনলাম আর পরে যা দেখলাম তা বার বার দংশন করছিল বিবেককে। তাই বিবেক আর দায়িত্ব কোনটা কে প্রাধান্য দেয়া যায় তাই নিয়ে ভাবছি। একদিকে আমিরাতের ভ্রমণ নিয়ে কিছু লিখে পাঠকদেরকে এ দেশের প্রতি আকৃষ্ট আর মোহ তৈরী করা। অপরদিকে এ দেশে প্রবাসী আমাদের দেশীয় ভাইবোনদের আবিষ্কৃত নতুন নতুন কমিউনিটি আর আত্মধিকৃত বিকৃত সংস্কৃতির পরিবেশনা। যা আমাদের সুশীল সমাজকে নিয়ে যাবে শুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে, অনিহার চাদরে আবৃত করবে আমাদের বিবেকবান মানব সমাজকে। আগত প্রজন্মকে ঠেলে দেবে পশ্চিমা সংস্কৃতির অগ্নিকুন্ডে।
আমিরাতে আমার চাকুরীকালীন সময়ের এক বন্ধুর বাসায় গত রাতে খাবার নিমন্ত্রণে গিয়ে আড্ডায় বসে যাই কয়েকজনে। কথা চলছিল আগামী কাল কেউ আমাকে নিয়ে যাবে তাদের এক এসোসিয়েশনের ঈদ সেলিব্রেশন পার্টিতে। শুধালাম, এই এসোসিয়েশনের কাজ কি? সে বললো-বলতে গেলে কিছুই না; আবার অনেক কিছু। আমিরাতে অনেকেই এসোসিয়েশন করে কমিউনিটিতে নিজেদের একটা পজিশন ধরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে। আবার অন্যদিকে এটা আমাদের জন্য কোন কাজের ব্যঘাত ঘটায় না; কারণ এর পেছনে কারোর তেমন কোন অতিরিক্ত সময়ও দিতে হয় না। মাসে কয়েকটি পারিবারিক প্রোগ্রাম করা হয়, যেখানে আমরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে খুব মজা করি, আবার কোন জাতীয় দিবস, বাংলাদেশের কোন ঐতিহ্যবাহী পার্বণ ইত্যাদিকে ঘিরে কিছু সরগরম। তবে হ্যা, আমরা সময়ে অসময়ে কিছু সেবামূলক কাজও করি। যা সত্যিই আমাদের সংগঠনের নাম উজ্বল করেছে। অন্যের ব্যাপারটা জানি না; তবে আমাকে ডাকা হয়েছিল এটা একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হবে বলে, তাই সানন্দে যোগ দিয়েছিলাম। শুরুতে কিছুটা তাকলেও এখন দেখি তা আর তেমন নেই। এর সদস্য আছি বলে কমিউনিটিতে স্থান আছে; না হয় কে কাকে ডাকে বল? কথায় কথায় ঊঠে এলো অনেক প্রসংগ। কে কি করে, কার কি দায়িত্ব? কে কার মাথায় নারকেল ভাঙ্গে… হাজারো কথা.. সমবয়সীদের আড্ডায় বসলে যা হয় আর কি! ওরা বলে যাচ্ছে আর আমি গিলে খাচ্ছি। পেশার খাতিরে অনেক কিছুই সহ্য করে নিতে হয়। তাই মনে করলাম যাই। অনেকদিন দুবাই থেকে দূরে থাকায় কেমন যেন একটু স্বাচ্ছন্দও মনে হচ্ছিল।
পৌছে গেলাম রাত আট টার দিকে। সদস্যবৃন্দ অবশ্যই আয়োজক হিসেবে পূর্বেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাকে সাথে নিয়ে যাওয়া বন্ধুকে কেউ একটু ডেকে বললেন, আপনার বন্ধুকে সামনের সারিতে বসার ব্যবস্থা করে দিন। যে হোটেলে আয়োজনটা ছিল তার পরিবেশ বেশ উন্নতমানের। একটু পরেই আমাদের মান্যবর কন্স্যাল জেনারেল সস্ত্রীক উপস্থিত হলেন। অনেকটা বাংলাদেশের পরিবেশ মনে হচ্ছিল। উপস্থাপক তার কাজ শুরু করলেন। প্রথমেই ঘোষনা দিলেন-আজকে আমরা এখানে ঈদের খুশীর জোয়ার বইয়ে দিতে এসেছি। তাহলে শুরু করা যাক আমাদের দেশীয় ঈদের গান দিয়েই।
পরিবেশটা ভালই লাগলো। এক পর্যায়ে মনে করলাম এখন বাসায় চলে যাই। কিন্তু বন্ধু বললেন- এই তো অনুষ্ঠান শেষের পথে। তখন মঞ্চে গান করছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত এক নামী কণ্ঠ শিল্পী। প্রথম সারিতে বসে আছেন যারা ওনারা আমিরাতে বিজনেস টাইকুন বলে পরিচিত মহোদয়গণ। যারা দেশের স্বার্থে প্রবাসের মাটিতেও রাজনীতির সংস্কৃতিকে জিঁইয়ে রেখেছেন। আর তার পেছনের সারিতে অধিকাংশই তাদের জীবন সঙ্গিনীরা। সাথে অবশ্যই আমাদের ছোট্ট মা মনিরা।
হঠাৎ শুরু হলো বাংলা গানের মেলোডি কুইন মমতাজের হট মিউজিক… বুকটা ফাইট্যা যায়। হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল দৃশ্যপট। একে একে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। নাচছেন পুরুষেরা, সাথে অনেকেই হাতে হাত দিয়ে দাপুটে বাদ্যের তালে তালে নাচছেন আমাদের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাবীরাও। মূহুর্তের মধ্যে শালীনতার বাঁধ ভেঙ্গে যায়; হয়ে ওঠেন আমুদে আর আত্মভোলা। কোথায় গেল মাথার কাপড়, কোথায় হাতের ব্যাগ! তিন তিনটে মুভি ক্যামেরায় বন্দি করা হচ্ছে ঈদের খুশীতে মাতোয়ারা স্মৃতিকে। বড় ভাইয়েরা নাচছেন আর বার বার ক্যামেরা এড়াতে চেষ্টা করছেন; তবে আমাদের বাংলার ললনারা তো আর কম সাহসী নয়; তারা নিজেদেরকে ক্যামেরার স্পটে নিয়ে আসতে যারপর নাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নৃত্যের জন্য দেখতে দেখতে মঞ্চের সামনে তৈরি হয়ে গেল গোলাকার এক বৃত্ত। এখানে মেয়ে আর পুরুষের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। কেউ আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেলফী নিতে। সদ্য বয়ঃপ্রাপ্তা মা মনিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ক্যামেরার সামনে আবেদনময়ী পোজ দিতে। কেউ আছেন গ্রুপ ফটোতে; আবার কেউ অন্যকে ইশারায় বলছেন তার স্টাইলিষ্ট ছবিটি ধারণ করতে। কেউ কেউ আবার ফেইসবুকে লাইভ আপডেট দিতেও ভুল করছেন না। যেখানে ভারতীয় লুঙ্গি ড্যান্স এর চর্চাও হয়ে ওঠে ঘনীভূত। একটা দারুন মজার ব্যাপার। দারুন অভিজ্ঞতা। আর সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ালো এই সব ভিডিও গুলো যখন ফেইসবুকে দেখলাম যা কিনা নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।
পাঠকের সাথে আমার হয়তো আর মনের মিল খাচ্ছে না এরপর থেকে। যে বাংলা সংস্কৃতির জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি। সেই বাংলা সংস্কৃতিকে বিকৃত করে গলিয়ে দেয়া হচ্ছে পশ্চিমা আর ভারতীয় অপসংস্কৃতির সাথে। যে কোমলমতি শিশুরা এ দেশেই লেখা পড়া শিখে বড় হয়েছে তাদের জন্যে আমরা বাংলার ঐতিহ্যের পরিবর্তে শেখাচ্ছি পশ্চিমা আদর্শ। মনে পড়ে গেল পারশ্যের বিখ্যাত কবি শেখ সাদি’র বোস্তান এর একটি কবিতার ছন্দ
” কাজী আর মা’ বা’ নাশীনাদ দর ফেশানদ দাস্তে রা,
মুহ্তাসিব গার মায় খোরাদ মা’জুরে দারাদ মাস্তে রা”
অর্থাৎ, যেখানে মাতা পিতার থেকে কোমলমতি সন্তানের শিখবে; সেখানে মাতা পিতাই যদি আদর্শহীন হয়ে পড়ে, সেখানে কি হতে পারে বুঝতে আর বাকী থাকে না। উৎকণ্ঠায় ভরে উঠলাম এ জন্যই যে এর আয়োজন ছিল একটি সোশ্যাল ক্লাব বা সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। যারা নাকী সমাজকে শেখাবে আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি, যারা নাকী সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করবে; তারাই যদি সমাজকে কলুষিত করায় লিপ্ত হয়ে পড়েন, তাহলে আমরা সাধারণ সমাজ যাব কোথায়? মাঝে মধ্যে নাকী সোশ্যাল কর্মকান্ড করেন তাই সোশ্যাল নামটি আংশিক যথাযথ হলেও ক্লাব শব্দটি যে শতভাগ যথাযথ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, অদ্ভূত রঙ বেরঙ্গের আলোর ঝলকানি আর ড্রাম এর কলজে কাঁপানো শব্দ…. উফ! এক পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল আমি দুবাই এর কোন নাইট ক্লাবে বসা।
মজার ব্যাপারটা হলো আরো কিসে ? আমি দুবাই থাকাকালীন সময়ে পরিচয় ছিল এক বড় ভাইয়ের সাথে। খুবই ভার-গম্ভীর থাকতেন তার স্ত্রী। আমি ভাবীর শ্রদ্ধাটুকু নিবেদন করতাম তাকে মায়ের মতো। এ ডান্স মঞ্চে তাকেও দেখে আমি আৎকে উঠলাম। পরিবেশের অসৎ ছোঁবলে তাকেও গ্রাস করেছে! আগ্রহ ভরে আরো জানতে ইচ্ছে করলো এ ক্লাবটির সম্পর্কে। যার নেতৃত্বে চলে এ ক্লাবটি তিনি নাকি কমিউনিটির একজন উচ্চ পেশাজীবি। আর সাধারণ সম্পাদক মহোদয় হলেন একটি প্রদেশের স্বদেশীয় রাজনৈতিক কর্ণধার। অন্যান্য যারা আছেন তাদের কেউ পেশাজীবি আবার কেউ ব্যবসায়ী। সবাই সয়ং সম্পূর্ণ; তাই কাজের অবসরে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখার নিমিত্তেই এ সংগঠন।
প্রমাণ ছাড়া তো প্রতিবেদন হয় না; তাই কিছু চিত্রও ক্যামেরাবন্দি করলাম। ঢাকায় এসে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম অফিসে রেখে যাওয়া টেবিলের জমে থাকা কাজের স্তুপে। তাই আবারো দেরী হলো। নতুন বছর শুরু হয়েছে। দেরী তো হয়েছে; কিন্তু দায়িত্বের বিষফোঁড়া বারংবার তাড়া দিচ্ছে কিছু একটা লিখতে। ক্লাবটির মূলমন্ত্রে লেখা আছে Bangladesh Social Club, Dubai, UAE is a proposed non-profit , non-political social organization committed to work for Bangladesh community in Dubai. Our prime objective is to cherish, promote and share the ideals and rich cultural heritage of Bangladesh.
আমি থেমে গেলাম শেষ কলামে গিয়ে rich cultural heritage of Bangladesh, তাহলে এটাই কি আমাদের কৃষ্টিকে ডেভেলপ করা? যেখানে শিষ্টাচারের রয়েছে প্রচুর অনুপস্থিতি। এ ধরণের সমাজ কল্যাণমূলক সংস্থা থেকে আমাদের নতুন প্রজন্ম কি শিখবে? শুনেছি এখানে কিছু সংগঠন আছে যারা পকেটের পয়সা খরচ করে শিশুদেরকে ডেকে এনে বাংলাদেশী সংস্কৃতি শেখায়। এরা নাকী তাদের সাথে টেক্কা দিয়ে নিজস্ব কৃষ্টিতে ড্যান্স গ্রুপ তৈরী করেছে। ভিনদেশীয় ভাষায় লেখাপড়া করে যারা নিজেদের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে মোটেও অবগত নয়; তাদেরকে আমাদের কৃষ্টির নামে পশ্চিমা আদর্শ শেখানো হচ্ছে। বেহায়াপনার তলদেশে নেমে এসেছে নিজেরা আর আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছে নির্লজ্জের অতল গহ্বরে।
হয়তো বিবেকের তাড়নার বহিঃপ্রকাশটুকু সম্পূর্ণ ভাবে ঘটাতে পারিনি তবুও এতটুকু নিজেকে সান্তনা দিতে পারি আপনাদের কাছে এই প্রশ্নটা রেখে “এ কি আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ, নাকি অপ-সংস্কৃতির ধুম্রজালে আমার সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের করুন আর্তনাদ” ?