কামাল হোসেন

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২ জানুয়ারি: বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা ড.কামাল হোসেন বলেছেন, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ নাগরিকদের কথার কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই৷ জনগণের কথা শোনার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে৷তিনি আরও বলেন,কেন রাষ্ট্র আজ মানবিবকতা হারিয়েছে? যদি রাষ্ট্রের মালিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকতো তবে তারা এটা করতে পারতো না৷ আমরা মালিকরাই বেহিসাবি হয়ে গেছি৷ তাই রাষ্ট্র আজ অমানবিক হয়ে গেছে৷’  শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন৷মহান বিজয় দিবস- ২০১৪ উপলক্ষে ‘৪৩তম বিজয় দিবস এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি শীর্ষক’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ পরিষদ৷

ক্ষমতাসীনরা ভুল করেও মুখ খুলছে না মন্তব্য করে কামাল হোসেন বলেন, আমি বলছি না আপনারা পদত্যাগ করুন৷ আমি বলছি আপনারা মুখ খুলুন৷ মুখ খুলে সমস্যার সমাধান করুন৷কামাল হোসেন বলেন, যারা ক্ষমতায় আছে তারা ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুট করে জনগণকে দুই আঙ্গুল (ভি চিহ্ন) দেখাচ্ছে৷ সরকার মনে করে যেকোনো মূল্যেই হোক, আমরা ক্ষমতায় আছি৷ ঐতিহ্যের সবগুলো খাত নষ্ট করে হলেও তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়৷তিনি বলেন, কেউ যদি মনে করে আজীবন ক্ষমতায় থাকবো, তবে তারা পাগলের স্বর্গে বসবাস করছে৷  ড. কামাল বলেন, ক্ষমতার মালিক জনগণ৷ মালিক এমনি এমনি হয়নি৷ অনেক রক্তের বিনিময়ে এই মালিকানা পেয়েছে৷ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের কাজ৷ যদি জনগণের স্বাধীনতা বিলীন করা হয়, তবে হাজার হাজার শহীদের আত্মাকে অবমাননা করা হবে৷

সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আর চুপ করে বসে থাকলে হবে না৷ গ্রামবাসী ভাই-বোনদের মনে রাখতে হবে আপনারাই রাষ্ট্রের মালিক৷ ছেলে-মেয়েদের এই ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝাতে হবে৷ এই ক্ষমতার উত্‍স কি, মালিকের কাজ কি সেটা বুঝাতে হবে৷ আপনাদের অসহায় বোধ করে বসে থাকার কোনো কারণ নেই৷ ঘরে ঘরে মানবাধিকার রক্ষা করার চেষ্টায় দুর্গ গড়ে তুলতে হবে৷’  তিনি বলেন, রাষ্ট্রের যেখানে যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন সেটা আমাদেরই করতে হবে৷ আশা করছি বিজয় আমাদের হবেই৷ড. কামাল বলেন, আগামী ৫ তারিখের পর আদলত খুলবে৷ সেখানে জিহাদের বাবাকে অবমাননার জন্য যে শুনানি হবে, আমি সেই শুনানিতে যাব৷ শুধু এটা না আরো যতো অবমাননার শুনানি হবে আমি সবগুলোতে যাব৷ যারা এই অবমাননাকারীদের আশ্রয় দিয়েছে তাদেরও বিচার হোক, আমি তার জন্য আদালতে যাব৷

‘অতীতকে নিয়ে অনেক সমালোচনাই করা যায়, কিন্তু নতুন বছরে আমরা ভবিষ্যত্‍ নিয়েই আশাবাদী হতে চাই’ উল্লেখ করেন খ্যাতিমান এই আইনীবী৷ তিনি বলেন, আসুন আমরা যে দলেরই হই না কেন, সংবিধানের মূলনীতি মেনে চলি৷ ইতিহাস প্রমাণ করেছে জনগণের বিজয় হবেই৷গণফোরামের সভাপতি, সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন আদালতের সব রকম অনিয়ম বন্ধে তদন্তের জন্য প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেবেন বলে জানিয়েছেন৷ চিঠির কী উত্তর পাবেন সেটাও আবার জানাবেন তিনি৷  এতে ড. কামাল হোসেন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের দেড় শ’ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে৷ অনেক সুনাম অর্জন করেছিল আদালত৷ সেটা নিয়ে আমাদের গর্বও অনেক৷ সে আদালতকে যদি রক্ষা করতে না পারি, স্বাধীনতা অর্থহীন হবে৷ সরকারের বিরুদ্ধে আদেশ চেয়ে না পেলে স্বাধীনতা অর্থহীন হবে৷

কোর্ট খুলবে আগামী ৫ তারিখ৷ আমি সেদিন যাবো৷ ভবিষতেও যত আদালত অবমাননার শুনানি হবে সব কয়টিতে যাবো৷ কেননা, অবমাননার জন্য যারা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটা সবচেয়ে বড় অবমাননা৷  তিনি বলেন,সেদিন লিখিত আকারে চিঠি দিবো প্রধান বিচারপতিকে৷ যে অন্তত ১০ জন প্রধান বিচারপতি বেঁচে আছেন৷ তাদের নিয়ে কমিটি করে তদন্ত করতে হবে৷ প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ রাখছি কথায় কথায় ভুল বুঝবেন না৷ চিঠিটা দিচ্ছি আশা করি দুই লাইনে উত্তর পাবো৷ ৫৫ বছর আইনের শাসনের জন্য সেবা করছি৷ অনুরোধ রাখার অন্তত সুযোগটা দেবেন৷ দুই লাইনের যে চিঠিটা দেব আশা করি উত্তর পাওয়া যাবে৷ যে তদন্ত করতে পারবেন না, অথবা বিবেচনা করবেন৷

মানবাধিকার বিষয়ে তিনি বলেন, জনগণ ক্ষমতার অধিকারী৷ এটা তো বাদ দেওয়া যায় না৷ তাই অসহায় বোধ করার কোনো কারণ নেই৷ সরকারের লোকরা ক্ষমতার মালিক এমন মনে করতে পারেন৷ কিন্তু দুর্বল করে রাখার অপচেষ্টা থেকে বাঁচতে হবে৷ তাই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে৷ বলতে হবে আমি এই দেশের মালিক৷ এই ক্ষমতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে৷ তিনি বলেন,প্রতিটি সরকারেই কালা- বোবা লোক থাকে৷ তবে সবাই কালা-বোবা হয় না৷ এই সরকারের সবাই কালা-বোবা না৷

শিশু জিহাদ নিহত হওয়ার ঘটনাকে সরকারের ব্যর্থতা আখ্যা দিয়ে প্রবীণ এ আইনজ্ঞ আরো বলেন, আল্লাহ মানুষের মুখ দিয়েছেন কথা বলার জন্য৷ আপনারা কালা- বোবা না থেকে কথা বলেন৷ ব্যর্থতার কথা বলেন৷ আর আমাদের মতো যাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তাদের কথাগুলো শুনুন যুক্তিযুক্ত কিনা৷ যুক্তি থাকলে তা মানুন৷ আর যেসব সংসদ সদস্যরা মনে করেন আপনাদের সঙ্গে সরকারের মিলছে না, তারা সরে দাঁড়ান৷ আপনাদের ১৬ কোটি মানুষের কথা শুনতে হবে৷  তিনি বলেন, রাষ্ট্র মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছে৷ সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলেই রাষ্ট্র এমন আচরণ করছে৷এ সময় নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আদালতে গেলে বলা হয় কোন কোর্ট? জাতীয়তাবাদী না আওয়ামী কোর্টে এসেছেন৷ কিন্তু জাতীয়তাবাদী নেই৷ সব আওয়ামী কোর্ট হয়ে গেছে৷ এসব বললে আবার আদালত অবমাননা হয়ে যাবে৷

তিনি বলেন, দেশের সর্বত্র আজ মানবতার ফরিয়াদ৷ যারা শুনলে পপ্রতকার হয়, তারা শোনে না৷ কিন্তু তাদের শোনার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে৷  নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রাষ্ট্র আজ অমানবিক হয়ে গেছে৷ একজন পিতা তার ছেলে হারিয়ে পাগলপ্রায়, তাকে ধরে নিয়ে ১২ ঘন্টা আটকে রাখা হয়েছে৷ থানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার গায়ের প্রহারের দাগ দেখিয়েছে৷ কতো বড় অমানবিক হলে এটা সম্ভব৷তিনি বলেন, ‘াষ্ট্রের বাহিনী গিয়ে সেখানে অভিযান চালিয়েছে৷ কিন্তু উদ্ধার করতে পারেনি৷ পরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছে, এখানে কিছুই নেই৷ ছেলেকে লুকিয়ে রেখে মিথ্যা বলেছে৷ যখন স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করেছে তখন ছেলেটিকে শাজাহানপুরে নিতে দেয়া হয়নি৷ পোস্টমর্টেম করে মরদেহ মুড়িয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে৷

তিনি আরো বলেন, এরপর যখন জিহাদের বাবা মামলা করতে গিয়েছে তখন কার কার নামে মামলা হয়েছে তাও সে জানে না৷ পুলিশ তাদের ইচ্ছামত কিছু লোকের নামে মামলা দিয়েছে৷সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে গিয়ে নিরাপত্তা চাইতে সবাই শঙ্কা প্রকাশ করছে৷ তাদের দ্বারাই নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হচ্ছে৷তাই কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তার বিরুদ্ধে সবাইকে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানান তিনি৷  আয়োজক সংগঠনের সভাপতি নুরুল হুদা মিলুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন- মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ পরিষদের উপদেষ্টা কাজী সিরাজ, বিএইচ আরএমসির পরিচালক ব্যারিস্টার মেজর (অব.) সরোয়ার হোসেন, নির্বাহী পরিচালক তালুকদার মুনিরুজ্জামান মনির প্রমুখ৷