দৈনিকবার্তা-কলাপাড়া, ২৯ ডিসেম্বর: পটুয়াখালীর কলাপাড়া এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল৷ এশিয়া মহাদেশে প্রথমবারের মতো ‘পানি জাদুঘরের’ উদ্বোধন করা হয়েছে৷ উপজেলার সবজির ভান্ডারখ্যাত নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পাখিমারায় কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের পাশে এ জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে৷ সোমবার বেলা ১১টায় জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনত্মর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ৷ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে একশন এইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টও ফারাহ্ কবির, কলাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব তালুকদার, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক খান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আভাসের নির্বাহী পরিচালন রহিমা সুলতানা কাজল, জনপ্রতিনিধি, উন্নয়নকমর্ীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন৷ ব্যতিক্রমধমর্ী এ জাদুঘরটি উদ্বোধনের পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দর্শনাথর্ীর ভিড়ে গোটা এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে৷
নদী ও পানি সম্পদ রক্ষায় সরকার ও নীতি নির্ধারকদের আরো উদ্যোগী করা৷ মানুষকে সচেতন করা এবং নদী ও পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে “পানি জাদুঘরের” প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রধান ধারক নদী ও পানি সম্পদ৷ দেশটিতে রয়েছে নদী ও পানির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ধারাবাহিকতা৷ কিন্তু জলবায়ূর দ্রম্নত পরিবর্তনজনিত কারণে নদী ভরাট ও হয়ে গেছে৷ নদী হারিয়ে গেছে মানুষের দখল দৌরাত্মে৷ মিষ্টি পানির প্রধান উত্স নদী তার উত্সস্থল হারিয়ে ফেলছে৷ এর প্রভাবে জীবন-জীবিকা হারাচ্ছে মানুষ৷ কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ধেয়ে আসছে৷ বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ৷ পশু-পাখির অভয়ারন্য, মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় অনত্মরায় হয়ে দাড়িয়েছে নদীপথের দ্রম্নত বিলোপ৷ এর নেতিবাচক প্রভাব এবং নদী রক্ষায় নেয়া সকল বিষয় উপজীব্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে জাদুঘরটিতে৷
মনোরম লোকেশনে জাদুঘরটির সামনে স্থান পেয়েছে নদীপথে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেয়ায় পানির প্রবাহ থমকে পরিণত হওয়া বালুরচরের দৃশ্য৷ যেখানে শোভা পাচ্ছে নদীতে নৌকা চলাচলের পথ স্থায়ীভাবে রম্নদ্ধ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট৷ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে জাদুঘরের মূল দরজায়৷ জাদুঘরে রাখা হয়েছে দেশের প্রধান মেঘনা, হালদা, গড়াই, বুড়িগঙ্গা, পায়রা, যমুনা, পদ্মা, তিসত্মা, কীর্তনখোলা, আন্ধারমানিক নদী থেকে সংগৃহীত পানির নমুনা৷ নদীপথে চলা নৌকা৷ নদীর পানি ব্যবহারের দৃশ্যপট৷ নদীকেন্দ্রীক জীবন-জীবিকার বিভিন্ন উপকরণ- মাছ ধরার চাঁই, বিভিন্ন ধরনের জাল, ঝুড়ি, খাড়ই, কাঠের সামগ্রী শোভা পাচ্ছে৷ রয়েছে নদীপথে চলাচল করা বিভিন্ন ডিজাইনের নৌকার চলাচল৷ আঞ্চলিক নদীপথ ও তার ওপরে সরকারের চলমান ব্রিজ নির্মাণের দৃশ্যপটসহ সামাজিক ম্যাপ উপস্থাপিত রয়েছে৷ রয়েছে দেশ-বিদেশের নদীর পরিসংখ্যান৷ নদীপথের নিয়ন্ত্রক দেশের নাম সমুহ৷ নদীর উত্সস্থল৷
উদ্যোক্তা সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশের যোগাযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানালেন, বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে৷ শত বছর আগে এর সংখ্যা ছিল দ্বিগুন৷ নদীর সংখ্যা কমায় নদী তীরবতর্ী মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে৷ বাঁধ, দুষণসহ নানা কারণে নদী হারিয়ে যাওয়ায় জীবন-জীবিকায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও নদীকে বাঁচাতে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক সংগঠন নানা ঘোষনায় এর গুরম্নত্ব তুলে ধরলেও সরকারের উদ্যোগ রয়েছে সীমিত পরিসরে৷ এরই প্রেৰাপটে নদী ও পানি সম্পদ রৰায় উন্নত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লৰ্যে পানি জাদুঘর গড়ে তোলার এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে৷ পানি জাদুঘরটি উদ্বোধন পরবতর্ী মানুষ নদীর প্রয়োজনীয়তা, নদী ভরাট হওয়ায় বিপর্যয়ৰেত্রসমুহের ভয়াবহতা দেখতে ভিড় শুরম্ন করে দেয়৷ ফলে নদী ও পানি সম্পদ রৰায় সরকার ও নীতিনির্ধারক মহল আরও উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন৷ এছাড়া সাধারণ মানুষ সচেতন হবে৷ এসব বাসত্মবতা দৃশ্যমান করতেই এ জাদুঘরের নির্মাণ৷ পানি সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করবে এ যাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে৷
উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “নদী মরে গেলে বাংলাদেশ মরে যাবে৷ কারণ পানি ও নদীর জন্যই বেঁচে আছে বাংলাদেশ৷ অথচ মানুষই এই নদীগুলোকে মেরে ফেলছে৷” তিনি আরো বলেন, “পানি জাদুঘরে মূলত এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে৷ নদীর কথা, পানির কথাকে উপজীব্য করে এই পানি জাদুঘর৷ এই জাদুঘর, মানুষকে, সরকারকে, নতুন প্রজন্মকে সচেতন করবে৷
ফারাহ্ কবির বলেন, “বাঁধ, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানা করণে নদী মরে গেছে, মরে যাচ্ছে৷ নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে দিনকে দিন৷ এর ফলে নদী পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে৷ আমরা চাই নদীকে নদীর মত বাঁচতে দিতে৷ তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে৷ সেজন্য সচেতন হতে হবে আমাদেরই৷ সে কারণেই এই পানি জাদুঘর”৷
উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘের সভাপতি জয়নাল আবেদীন জানান, মানুষ জীব-জন্তু কিংবা পশু-পাখির জাদুঘর দেখেছে৷ কিন্তু পানি জাদুঘরের নাম আগে কেউ শোনেনি৷ এর গুরম্নত্ব বোঝা তাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য খুবই জরম্নরি৷
ব্যতিক্রমধমর্ী “পানি জাদুঘরটির” উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে নীলগঞ্জের কৃষক-কৃষাণিসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করে উত্সবমুখর পরিবশে৷ পাশাপাশি উপমহাদেশে প্রথম জাদুঘরটি কলাপাড়ায় প্রতিষ্ঠার জন্য এখানকার কৃষকমৈত্রী, গণগবেষণা দলের নেতৃবৃন্দ উদ্যোক্ত সংস্থাকে ধন্যবাদ জানান৷ শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠী নয়, কুয়াকাটাগামী পর্যটক-দর্শনাথর্ীকে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে ব্যতিক্রমধমর্ী “পানি জাদুঘরটির” নাম শোনায়৷ ঘুরে-ফিরে দেখতে শুরু করেছেন আগতরা জাদুঘরটির ভেতর-বাইরে৷ জানতে চাচ্ছেন কেনইবা পানি জাদুঘর৷ মোটকথা রাতারাতি কলাপাড়ার পাখিমারার পানি জাদুঘরটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে এজনপদ থেকে অন্য জনপদে৷