দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২৮ ডিসেম্বর: মাথায় আঘাত ও পানিতে ডুবে শিশু জিহাদের মৃতু্য হয়েছে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ কথা জানিয়েছেন৷ রোববার সকালে শিশু জিহাদের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ মৃতদেহ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
এর আগে শনিবার বিকেলে প্রায় ২৪ ঘন্টা পর উদ্ধার করা হয় শাহজাহানপুর রেলওয়ের কলোনিতে গভীর নলকূপে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদকে৷ ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণার কয়েক মিনিটের মাথায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিত্সকরা জিয়াদকে মৃত ঘোষণা করেন৷
এদিকে, মৃতু্যর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও রেলওয়ের প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে শনিবার রাতে শাহজাহানপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন নিহতের বাবা৷ পরিত্যক্ত নলকূপের কয়েকশ ফুট গভীর পাইপে পড়ে যাওয়ার সময় মাথায় আঘাত পেলেও পানির কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশু জিহাদের মৃতু্য হয়েছে বলে ধারণা করছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সকরা৷
রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চার বছর বয়সী শিশুটির লাশের ময়নাতদন্তের পর হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ কথা জানান৷তিনি বলেন, ছেলেটির মাথার ভেতরে ও বাইরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে৷তবে পাইপে পানি ছিল৷ আমাদের ধারণা হয়েছে, পাইপে পড়ে যাওয়ার দুই ঘন্টার মধ্যে পানিতে ডুবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশুটির মৃতু্য হয়েছে৷হাবিবুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম শফিউজ্জামান ও প্রভাষক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস ময়নাতদন্তে অংশ নেন৷
শাহজাহানপুর থানার এস আই আবু জাফর জানান, ময়নাতদন্ত শেষে রোববার সকাল পৌনে ১০টার দিকে শিশুটির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷
জিহাদের মা খাদিজা আক্তার ও বাবা নাসির ফকির ময়নাতদন্তের সময় হাসপাতালেই অপেক্ষা করেন৷শিশুটির মামা মনির হোসেন জানান, জিহাদকে তারা শরীয়তপুরের ডামুড্যায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তাকে দাফন করা হবে৷শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির মাঠে পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের খোলা মুখ দিয়ে কয়েকশ ফুট গভীর পাইপে পড়ে যায় জিহাদ৷
২৩ ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা শনিবার বিকাল ৩টায় জানান, তারা পাইপে জিহাদের কোনো খোঁজ পাননি৷ কিন্তু এর দশ মিনিটের মাথায় একদল উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবী হাতে তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ওই পাইপ থেকেই জিহাদকে তুলে আনেন৷
তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিত্সক জানান, অনেক আগেই শিশুটির মৃতু্য হয়েছে৷শনিবার জিহাদের লাশের সুরত্হাল প্রতিবেদন তৈরি করেন শাহজাহানপুর থানার উপ পরিদর্শক আবু জাফর৷তিনি বলেছিলেন, ওর মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়া ছিলে গিয়েছিল৷ প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে পাইপের ভেতর অঙ্েিজন না থাকায় তার মৃতু্য হয়েছে৷কখন সে মারা গিয়ে থাকতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, এগুলো চিকিত্সক ভালো বলতে পারবেন৷
এদিকে, শিশু জিহাদের উদ্ধার তত্পরতার মধ্যে পাইপে তার অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল৷ অভিযোগ ওঠেছে, ওই মন্তব্যের পরই উদ্ধার তত্পরতা শিথিল হয়ে পড়েছিল৷ কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন, মন্ত্রী দায়িত্বহীন বক্তব্য না দিলে হয়তো সব ঠিকঠাক থাকতো, জীবিত জিহাদকে পেত স্বজনরা৷ঘটনাস্থল ছাড়াও ফেইসবুক ওই বক্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের পাশাপাশি ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচারও চেয়েছেন তারা৷
শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে চারবছর বয়সী শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়ার পর প্রায় ২৩ ঘন্টা ধরে চলে রুদ্ধশ্বাস অভিযান৷ পাইপের ভেতরে চটের বস্তা, দড়ি, ক্যামেরা নামিয়ে চলে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা৷ক্যামেরায় পাইপের ভেতরে মানবদেহের অস্তিত্ব না পাওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানোর পর শনিবার ভোররাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পাইপে জিহাদের অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন৷
তিনি বলেন, আমার মনে হল, এখানে কেউ নাই৷ তারপরও সেখানে যে আবর্জনা আছে, তা তুলে দেখা হবে৷ ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন৷ তবে আমি নিশ্চিত, এখানে কোনো মানুষ নেই৷তারও ১১ ঘন্টা পর শনিবার দুপুরের পর পাইপে জিহাদ নেই বলে ফায়ার সার্ভিস অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক তরুণের প্রচেষ্টায় জিহাদকে পাইপের ভেতর থেকে তুলে আনা হয়৷ পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় হাসপাতালে৷
ইমেজ প্রসেসিংয়ে পড়াশোনা থাকা এই শিক্ষক বলেন,স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা তাকে একটি মনিটরে কি যেন দেখালেন৷ এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন৷ এরপরই ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ শিথিল করে ফেলে৷ উপস্থিত অনেক সাংবাদিক ঘটনাস্থল থেকে চলে যান৷ফায়ার সার্ভিস বলেছে তারা পাইপে অঙ্েিজন সরবরাহ করেছে৷ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সংশয় প্রকাশের পর কিছু সময়ের জন্যও যদি অঙ্েিজন বন্ধ রাখা হয় তবে শিশুটির বাঁচার কথা না৷ একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ভূমিকা কাম্য নয়৷ তার সংশয় প্রকাশের পরই গোলমালটা বাঁধে৷ যদি এমনটি না ঘটত, তাহলে হয়ত রাতেই জিহাদকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হত৷
উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করলে অবশ্যই শিশুটির অবস্থান শনাক্ত করা যেত৷ এটি কোনো রকেট সায়েন্স না, আমাদের দেশে নিশ্চয়ই এমন ক্যামেরা আছে৷ তাহলে কেন তার ব্যবহার হলো না?
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে একটি স্পেশাল স্কোয়াড বসাতে পারত, কীভাবে কাজ করে শিশুটিকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব সেটি নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে ডিভিও কনফারেন্স করতে পারত, কারো সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারত৷ তাদের সেই রকম কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়েনি৷প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর দড়ি নিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে কাজ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সাহেদুর রহমান৷
অবশ্য পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশের কথা স্বীকার করলেও উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলেননি বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী৷তিনি বলেন, শনিবার ভোররাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আমাকে ডেকে নিয়ে ক্যামেরা দেখালো, মনিটর দেখালো৷ জীবন্ত কিছু তখন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল না৷
আমি চলে যাওয়ার পরও ফায়ার সার্ভিস ঘন্টাখানেক কাজ করেছিল৷ তারা তখন বলেছিল ২৭০ ফুট পর্যন্ত তারা শিশুর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে না৷ পাইপটি ছিল প্রায় ৪০০ ফুট৷ সেখানে কিছু সলিড সাবসটেন্স থাকায় একেবারে পাইপের নিচে কি আছে তা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না৷ সলিড সাবসটেন্স সরাতে কিছু অ্যাটাচমেন্ট দরকার ছিল৷ রোববার সকালে সেসব সরানোর ব্যবস্থা করার কথা বলে আমি চলে গিয়েছিলাম৷ তারপরও তো ফায়ার সার্ভিস কাজ করেছে৷তাছাড়া আমি কিন্তু তাদের উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলি নাই, অভিযান চালিয়ে যেতে বলেছিলাম৷ তারা কাজে শিথিলতা দেখিয়েছে এমনটা হয়তো সত্য না, তারপরও আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখবো৷
জিহাদকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস কোনো ধরনের শিথিলতা দেখায়নি বলে দাবি করেছেন বাহিনীর মহাপরিচালক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খানও, যিনি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ শুরুর আনুমানিক আট ঘন্টা পর সেখানে গিয়েছিলেন৷
তিনি দাবি করেন, শিশু জিহাদকে উদ্ধারে তার বাহিনীর আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না৷ উদ্ধার অভিযানে কোনো শিথিলতাও ছিল না৷ নিজেদের যা আছে তা নিয়ে উদ্ধার তত্পরতা চালানোর চেষ্টা হয়েছে৷আমাদের নিজেদের উন্নত ক্যামেরা নেই৷ ওয়াসার সাধারণ ক্যামেরার ওপর ভরসা করতে হয়েছে৷ সেটিও সার্চ ভিশন ক্যামেরা না, সাধারণ কামেরা৷ তাছাড়া, জিহাদকে উদ্ধারে আগে পাইপের ভেতর নামানো কিছু জিনিস সেখানে রয়ে গিয়েছিল, ফলে ক্যামেরায় পুরো ভিউ পাওয়া যায়নি৷নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার না করলেও শিশুটিকে উদ্ধার করা তরুণদের সাধুবাদ জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক৷
