01মংলা প্রতিনিধি, ২০ ডিসেম্বর শনিবার–কিং কোবরা, ব্লাক কোবরা, খয়ে গোফরা, গ্রীণ ভাইপার সুন্দরবনের বিষধরসব সাপের নাম। এরকম সাপরাই নাকি গত ৪ বছর ধরে দখল করে রেখেছে সুন্দরবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মৃধামারী টহল ফাঁড়িটিকে। সম্প্রতি সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। মংলার জয়মনি ফরেষ্ট ঘাট এলাকা থেকে বায়ে শ্যালা নদীর প্রায় এক ন্যাটিকেল মাইল দূরে গেলে বন বিভাগের এই পরিত্যাক্ত অফিসটির সন্ধান মিলবে। যার চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে লতাপাতা আর বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালি। স্থানীয়রা এটাকে সাপের বাড়ি হিসাবেও চিহ্নিত করেন।
ট্রলার চালক ফরিদ শেখ (২৮)  জানান- আনুমানিক ৩০ বছর আগে মৃগামারী টহল ফাঁড়িটি করা হয়। প্রথমে এটি গোল পাতার তৈরি  ছিলো।  এক দশক আগে টিন দিয়ে মোড়ানো হয়। কিন্তু বিগত তিন থেকে চার বছর আগে বনদস্যু জুলফু বাহিনীর অত্যাচারে অফিসটি গুটিয়ে নেন বনবিভাগ। এরপর থেকে জায়গাটি পরিত্যক্ত থাকায়  ভেতরে বাসা বেঁধেছে বিষাক্ত বিষধরসব সাপ।
এ ব্যাপারে সুন্দরবনের  প্রাণী বিশেষজ্ঞ আ. রব এ প্রতিবেদককে বলেন- সুন্দরবনে পরিত্যাক্ত কোন বন অফিস থাকলে সেখানে সাপ যাবে এটা অস্বাভাবিক কিছুই না। কারণ এটা তাদের এলাকা এবং তাদের বাসস্থান।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসেন চৌধুরী এ প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন-চার বছর ধরে মৃগামারি টহল অফিসটি কিছু কৌশলগত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কি কারণে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে দায়িত্ব নেয়ার আগেই অফিসটি বন্ধ হয়েছে। তাই বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। তবে শ্যালা নদীর আন্দারমানিক স্থানে আরেকটি টহল অফিস করা হয়েছে। সেখান থেকে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
বাঘসহ নানান পশু-পাখির অভয়ারন্য হিসেবে শ্যালা নদীর মৃগামারি খালের আশপাশের এলাকাটি ভূমিকা রাখে, তাই অফিস বন্ধ থাকাতে বাঘ, কুমির এবং হরিণ নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অফিসটি বন্ধ করাতে এখানে এখন বাঘ দেখা যায়। তা না হলে এখানে বাঘ আসতো না।
বিষধর সাপের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, সাপ তো রয়েছেই। তবে অফিস বন্ধ করার ক্ষেত্রে এটিই মূল কারণ নয়। আমাদের লোকবলের অভাব রয়েছে। বর্তমানে পূর্ব বিভাগীয় সুন্দরবনের আশপাশের নিরাপত্তায় ৭৫ জন গার্ডসহ ২৩০ জন বোর্টম্যান রয়েছে। যাদের এই পুরো এলাকার নিরাপত্তা দিতে হয়। অফিস বেশি হলে নির্দিষ্ট এলাকার জন্য ৪-৫ জন মিলে পাহারা দিতে হয়। যা অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই বনের নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে অফিস কমানো হয়েছে।
তবে জয়মনি ঠোটা ঘাটে স্থানীয় এনজিও সংস্থা প্রথম সূর্যের সভাপতি গাজী রফিকুল ইসলাম  বলেন, যদিও পূর্ব বিভাগীয় সুন্দরবন রক্ষায় এই অফিস করা হয়ে ছিলো । কিন্তু প্রায় শোনা যেত জলফু বাহিনীর সদস্যরা এই স্থানে এসে ফরেস্টের লোকদের জিম্মি করে তারা এই অফিসে রাত যাপন করত। এছাড়া দস্যুরা বন বিভাগের কর্মীদের ওপর অত্যাচার করত। পরবর্তীতে বন বিভাগ বেগতিক অবস্থার কারণে অফিসটি বন্ধ করে দেয়।
সেভ দি সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ড.শেখ ফরিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন- মৃগামারি পয়েন্টে অবস্থিত বন বিভাগের এই অফিসটির কার্যক্রম সচল থাকলে শ্যালা নদীতে চলাচলরত জাহাজগুলোকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়াসহ স্থানীয় জেলেদের নিরাপত্তায় গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন হতো। এছাড়া এই অফিসটি থাকলে বাঘ-হরিণ, ডলফিন, সুন্দরী, বাইন, পশুরসহ মহামূল্যবান গাছগুলো  পাচারকারীদের কাছ থেকে নিরাপদ থাকতো বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি।
১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে।সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখন্ডে সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায়। ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় পার্ক নামে। সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা।
মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানা ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ৫০০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।