risk analysis institute

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ ডিসেম্বর: রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম৷ এ তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফটের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ এর জন্য দায়ী করা হয়েছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে৷ পরেই জামাতে ইসলামীর নাম৷ তবে তিন দলই সহিংসতার দায় অস্বীকার করেছে৷ম্যাপলক্রফটের বরাতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য স্টেট অব গভনর্্যান্স বাংলাদেশ-২০১৩ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে৷শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে৷রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশ ২১ নম্বওে অতি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার প্রথমে রয়েছে সিরিয়া৷এরপর যথাক্রমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ইরাক ও দক্ষিণ সুদান৷ পাকিস্তানের অবস্থান ১০ নম্বরে৷ মাওবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর সহিংসতাপূর্ণ ভারতের অবস্থান ১৮তম৷ সহিংসতা সবচেয়ে কম স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশ নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডে৷ প্রতিবেদনটিতে শুধু সহিংসতা নয়,দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা, সংসদে ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলাদের আধিপত্য, পারিবারিক রাজনীতি চর্চা, বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন এবং পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয়করণের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে৷

প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে সংবাদপত্রের সংবাদ, জরিপ, বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত একত্র করার মাধ্যমে৷ বিশিষ্ট নাগরিকদের সাক্ষাত্‍কার ও বইয়ের তথ্যও নেওয়া হয়েছে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারাদেশে দুই হাজার ৭২৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতি বছর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশ৷ এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ, অর্থাত্‍ এক হাজার ১৮০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে শুধু ২০১৩ সালে৷ এতে প্রাণ গেছে ৫১৯ জনের৷ ২০১৩ সালে এক বছরেই নিহত হয়েছেন ২৭৩ জন, যা আগের চার বছরের চেয়ে বেশি৷ আহত হয়েছেন ৩৩ হাজার ৭০২ জন৷ ভাংচুর করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫৯টি যানবাহন, দোকান, বাড়ি ও ঘর৷ আগুনে পুড়েছে ৫১৪টি যানবাহন ও দোকান৷ এই সহিংসতার জন্য মূলত দায়ী করা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতকে৷প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি ঘটনার জন্যই দায়ী রাজনৈতিক দলগুলো৷ সহিংসতায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট৷ তবে একক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে নেই৷ ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ শাসক দলের বিরুদ্ধে৷ দেড় হাজার সহিংসতার ৮৯৪টিতে জড়িয়েছে দলটির নাম৷

তবে এ অভিযোগকে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ব্র্যাকের নিজস্ব কোনো গবেষণা কিংবা সেল নেই৷ কেবল সংবাদপত্রের সংবাদ ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তারা এই প্রতিবেদন করেছে৷ অন্যের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা প্রতিবেদনের মন্তব্য করার কারণ নেই৷সহিংসতা ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়ে গেছে বিএনপি-জামায়াত জোট৷ ওই বছরে সংঘটিত ৭৬ শতাংশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জোটের বিরুদ্ধে৷ ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ২১ শতাংশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷ আগের চার বছরে বিএনপি এককভাবে মোট সহিংসতার ২৫ শতাংশে জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ জামায়াত জড়িত ৮ শতাংশে৷ ২ শতাংশ সহিংসতা বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধভাবে করেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে৷ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ১ শতাংশ সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে প্রতিবেদনে৷

বিএনপি ও জামাত উভয় দলই সহিংসতার দায় অস্বীকার করেছে৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন ঠেকাতে সরকারই সহিংসতা করেছে৷ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এ দায় এখন বিএনপির ওপর চাপানো হচ্ছে৷ একই সুরে দায় অস্বীকার করেন জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের৷ রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আওয়ামী লীগের নাম সর্বাগ্রে৷ দলটির কর্মীদের মোট সংঘাতের ৭১ শতাংশই হয়েছে নিজেদের মধ্যে৷ বাকিগুলো অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে৷ বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের পরিমাণ ৬০ শতাংশ৷ বাকি সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে৷ জামায়াতের ৯৯ শতাংশ সংঘাতই হয়েছে পুলিশ ও অন্য দলের কর্মীদের সঙ্গে৷সহিংসতায় বেশি জড়িত ছাত্রলীগ৷ গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার ২৭ শতাংশের জন্যই প্রতিবেদনে ছাত্রলীগকে দায়ী করা হয়েছে৷ পরের অবস্থানে রয়েছে ছাত্রদল৷ ৫ শতাংশের ঘটনায় জড়িত এই সংগঠন৷ ছাত্রশিবির জড়িত ৪ শতাংশ ঘটনায়৷ সহিংসতার জেলাওয়ারি চিত্রে সবার ওপরে ঢাকার নাম৷ সবার নিচে বান্দরবান৷ ২০১৩ সালে ৫২ শতাংশ সহিংসতা হয়েছে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হরতাল-অবরোধকেন্দ্রিক৷ এর আগের চার বছরে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক দাবিকে কেন্দ্র করে৷ দল দুটি ২০১০ সাল থেকেই নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে৷

প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদে মোট এমপির প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী৷ অষ্টম ও নবম সংসদে এ সংখ্যা ছিল ৫৯ ও ৬০৷ এবারের সংসদে বিএনপি না থাকলেও মোট এমপির ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়ী৷ আওয়ামী লীগের ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী৷ আগের সংসদে বিএনপির ৭৭ শতাংশ এমপি ছিলেন ব্যবসায়ী৷ এমপিদের মধ্যে ৪৩ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা রয়েছে৷ চলতি সংসদে আওয়ামী লীগের ৪৪ শতাংশ এমপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা রয়েছে৷ এর আগের সংসদে বিএনপির ৭৯ শতাংশ এমপি মামলার আসামি ছিলেন৷ এবারের সংসদে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ১১ এমপির বিরুদ্ধে৷ আওয়ামী লীগের ১২ এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে৷ আগের সংসদে বিএনপির ৩৩ শতাংশ অভিযুক্ত ছিলেন৷প্রতিবেদনে বলা হয়, পারিবারিক রাজনীতি ব্যাহত করছে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে৷ নবম সংসদে ১৯ শতাংশ এমপিই ছিলেন সাবেক এমপিদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যা৷ অষ্টম সংসদে এই হার ছিল ১৭ শতাংশ৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তিন দলে পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন৷ রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চাকে হতাশাজনক বলা হয় প্রতিবেদনে৷ এতে বলা হয়, সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে মাত্র ১২ শতাংশ মনোনয়ন দেওয়া হয় তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে৷ ৮৮ শতাংশই হয় শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছায়৷ প্রধান দুই দলের মূল ভিত্তি জেলা শাখার সম্মেলনেও দলীয় গঠনতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রীতি মেনে হয় না৷ দুই দলের ৬৭ শতাংশ জেলা কমিটিতে সম্মেলন হয় অন্তত ১০ বছর ব্যবধানে৷ জেলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের চেয়ে মনোনয়নের বেশি নজির বিএনপিতে৷ গত পাঁচ বছরে দলটিতে ১৮ শতাংশ জেলা কমিটিতে সভাপতি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন না করে কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়৷ আওয়ামী লীগের এ হার ১২ শতাংশ৷ গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের ৬৫ শতাংশ জেলা কমিটিতেই নেতা নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়৷ বিএনপিতে এ হার ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ৷ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দল এ দায়ও অস্বীকার করেছে৷

রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ে অস্বচ্ছতার বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে৷ তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে স্বচ্ছতায় কিছুটা এগিয়ে আওয়ামী লীগ৷ জেলা পর্যায়ে দলীয় কর্মীদের কাছ থেকে অনুদান বাবদ বিএনপি আয় করে মোট আয়ের ৪৫ শতাংশ৷ আওয়ামী লীগ আয় করে ৬৫ শতাংশ৷ বিএনপি বাকি আয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা দিয়ে পাওয়া৷ আওয়ামী লীগের আয়ের ২১ শতাংশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা হিসেবে পাওয়া৷পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চিত্র ও দলীয়করণের চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে৷ বিএনপি জোট সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া ৮৫০ সহকারী পরিদর্শকের (এসআই) ৯০ শতাংশই ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মী ছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়৷ একই চিত্র দেখা হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া এক হাজার ৫২০ জন এসআই নিয়োগে৷ বিএনপি সরকারের আমলে বিশেষ জেলার কর্মকর্তাদের \’পুরস্কৃত\’ করার ধারা এ সরকারের আমালে প্রকট হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়৷ আওয়ামী লীগ আমলে একটি বিশেষ জেলার পুলিশ সদস্যদের ব্যাপক \’পুরস্কৃত\’ করা হয়েছে৷ এতে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণকে সরকারের চেয়ে বেশি পুলিশকে টাকা দিতে হয়৷ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৫০ শতাংশের বেশী মানুষ মনে করেন পুলিশ অতি দুর্নীতিপ্রবণ একটি বাহিনী৷