দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর: জামিন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিবন্ধ লেখার দায়ে হাইকোর্ট দোষী সাব্যস্ত করার পর, এবার প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে লেখা একটি মন্তব্য প্রতিবেদনের জন্য দৈনিক প্রথম আলো’র সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান এবং যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে তলব করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বেছে নেওয়া শিরোনামে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে কেন তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে৷
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয় বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান৷আদেশে আগামী ৫ জানুয়ারি এই দুই সাংবাদিককে আদালতে হাজির হয়ে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে৷আদালতের গুরুতর অবমাননার দায়ে এর আগেও মিজানুর রহমান খানকে সাজা দিয়েছে আদালত, সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে প্রথম আলোকে৷
সোমবার প্রথম আলোতে প্রধান বিচারপতি বেছে নেওয়া শিরোনামে মিজানুর রহমান খানের লেখা ওই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ১৬ জানুয়ারি ২০১৫ অবসরে যাওয়ার কারণে আরেকজন নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সামনে এসেছে৷ এই পদে নিয়োগে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, তা নিয়ে তেমন আলোচনা কখনো হয়নি৷দ্বাদশ সংশোধনী প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ রদ করেছিল৷ কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে৷ বর্তমান টওধান বিচারপতির টানা তিন বছর এই পদে থাকা বিরল ঘটনা৷
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনলে আদালত তাকে আবেদন করতে বলেন৷পরে ব্যারিস্টার সিরাজুম মুনির আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে আবেদন করলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান খানকে তলব করে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান৷
শুনানিতে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন,মিজানুর তার পুরো লেখায় আপিল বিভাগের মর্যাদাহানী করেছেন৷ তার লেখা পড়ে মনে হয়, যেন কেবিনেট সেক্রেটারি অথবা উত্তর পাড়া থেকে কোন লোক এনে প্রধান বিচারপতি করা হয়.. আপনাদের কারও যোগ্যতা নেই প্রধান বিচারপতি হওয়ার৷এ সময় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেন, এটা বোঝার জন্য শিক্ষা থাকতে হয়৷ এ রকম অর্ধ শিক্ষিত কীভাবে এটা বুঝবে? এ জন্য অর্ধশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত ভাল৷ কোনো এক জ্ঞানী মনীষী বলেছেন, তোমরা অশিক্ষিতের কাছে যাও কিন্তু অর্ধ শিক্ষিতের কাছে যেও না৷
রোকন উদ্দিন মাহমুদ ওই নিবন্ধের একটি অংশ পড়ে শুনিয়ে বলেন, তিনি লিখেছে, নিম্ন আদালতের বিচারক অথবা বাইরে থেকে যোগ্য যে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে সংবিধান বাধা নয়৷ এ উক্তির মাধ্যমে তিনি আদালতের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন৷
উনি লিখেছেন, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নিয়োগ বিএনপি সরকারের আমলে স্থায়ী হয়৷ এ লেখার দ্বারা উনি কি বোঝাতে চেয়েছেন?এ সময় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়৷ বিচারপতি এসকে সিনহার চাকরিও বিএনপির আমলে স্থায়ী হয়৷
ব্যারিস্টার রোকন বলেন, উনি লিখেছেন, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের মতামত নিতে হবে৷ উনি নির্বাহী বিভাগের প্রেমে পড়েছেন৷এ সময় একজন বিচারপতি বলেন, এটা খুবই বিপজ্জনক কথা৷আদালত এ পর্যায়ে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামকে শুনানিতে অংশ নিতে ডাকেন৷ আদালতে উপস্থিত মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আদালতের এখতিয়ার কখনও চ্যালেঞ্জ করা যায় না৷ আপনারা তাদের বিরুদ্ধে এখনই কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? শোকজ করা যেতে পারে৷ তারা তাদের ব্যাখ্যা দিক৷
আদালতের আহ্বানে আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, মিজানুর রহমান খান একজন স্বভাবজাত আদালত অবমাননাকারী৷ অতীতে তিনি অনেকবার আদালত অবমাননা করেছেন৷ আপনারা হলফনামায় ব্যাখ্যাসহ ব্যক্তিগত হাজিরার আদেশ দিতে পারেন৷
নিবন্ধের কিছু অংশ আদালতে উপস্থাপন করে আটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তার এ লেখা অবমানাকর৷ ১৯৭৪ সালের আমাদের কোর্টকে এভাবে কেউ মেলাইন করে নাই৷
পরে মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম আলোতে বিচারপতি নিয়োগ, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে লেখায় মিজানুর রহমান খান যেসব উক্তি করেছেন তা আদালতের গোচরে আনা হয়েছে৷ একজন আইনজীবীও দরখাস্ত করেছেন৷তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে৷ আদালত সেই দরখাস্তের ভিত্তিতে রুল দিয়ে তাদের হাজির হতে বলেছেন৷ ৫ জানুয়ারি দুইজনকে আদালতে সশরীরে হাজির থাকতে হবে৷
মাহবুবে আলমের দাবি, আদালত ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে এ ধরনের লেখা অন্তত ১৯৪৭ সালের পরে আর লেখা হয়নি৷
পরোক্ষভাবে লেখক যেটা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, সেটা হলো, প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য বিচারক হিসাবে আসীন কেউ উপযুক্ত নন৷ মর্মার্থ সেটাই দাঁড়ায়৷ যদিও সরাসরি এ ধরনের কোনো কথা বলেননি৷কিন্তু পরোক্ষভাবে, বিচারকদের দক্ষতা, পারদর্শিতা এবং অন্যান্য বিষয়গুলোর উল্লেখ করে যে কটাক্ষ তিনি করেছেন, সেটা গর্হিত এবং আদালত অবমাননাকর৷
আইনজীবীরা সবাই একই বক্তব্য দিয়েছেন৷ তারা বলেছেন, এ ধরনের লেখার ফলে আদালতের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে৷ সব ক’জন আইনজীবী একবাক্যে বলেছেন, আদালতের প্রতি আস্থা নষ্ট করার এটা একটা প্রয়াস৷সামপ্রতিক সময়ে সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে একাধিক আদালতের আদেশে সংবাদ মাধমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, না৷ একেবারেই না৷দরখাস্তকারীর আইনজীবী বারবার বলেছেন, এই সাংবাদিক রিপিটেডলি আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছেন৷ কাজেই একজন বিশেষ সাংবাদিকের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার অর্থ এই না যে, সমগ্র মিডিয়ার ওপরে কোনোরকম হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা৷
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আট বিচারকের সবাই এ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সাবই মিলেই রুল দিয়েছেন৷বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না৷