দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর: নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চাকরিচু্যত র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ এবং অপর দুই কর্মকর্তা সাবেক কোম্পানি কমান্ডার আরিফ হোসেন ও এমএম রানা জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ তবে তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেন অপহরণ থেকে শুরু করে মরদেহ নদীতে ডোবানো পর্যন্ত পুরো ঘটনায় জড়িত থাকলেও এমএম রানা অপহরণ পর্যন্ত আংশিক জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলেছে র্যাব৷
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত র্যাব সদর দফতরের তদন্ত কমিটির এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন বুধবার হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে৷ বিচারপতি মোহাম্মদ রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম৷এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির প্রধান র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি আফতাব উদ্দিন৷র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত খুনের ঘটনায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত (অপহরণ থেকে শুরু করে মরদেহ নদীতে ডোবানো পর্যন্ত) র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন সিপিএসসি জড়িত ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়৷ কিন্তু লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা অপহরণ পর্যন্ত অংশ নিয়ে আংশিক জড়িত ছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়৷
তবে ঘটনার সঙ্গে র্যাব সদর দফতরের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷প্রতিবেদনে র্যাব আরও বলেছে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই কাউন্সিলার নূর হোসেন কাউন্সিলার নজরুল ইসলামকে অপহরণ ও খুনের পরিকল্পনা করেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়৷
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় হাইকোর্টে উপস্থাপন করা র্যাবের প্রতিবেদন মামলার বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না৷ এ বিষয়ে ডিবি যে চার্জশিট দাখিল করবে, তার ভিত্তিতেই মামলার বিচার হবে৷তিনি আরো বলেন, এটা র্যাবের বিভাগীয় রিপোর্ট৷ ৭ খুনের বিষয়ে র্যাবের ভূমিকা কি ছিল তা এ প্রতিবেদনে বের হয়ে এসেছে৷
এদের মধ্যে ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ ও কোম্পানি কমান্ডার আরিফ নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়রসহ সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ডুবনো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন৷আর রানা অপহরণে অংশ নিয়ে ঘটনায় আংশিক জড়িত ছিলেন বলে র্যাবের এই অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে৷এই তিনজনসহ র্যাবের মোট ২১ সদস্যের নাম এসেছে র প্রতিবেদনে, যারা কোনো না কোনোভাবে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে৷
আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে র্যাব সদস্যদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার আট মাস পর বুধবার এই এলিট বাহিনীর প্রতিবেদন হাই কোর্টে উপস্থাপন করা হয়৷
আদালতে প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম৷ তার হাতে এই প্রতিবেদন আসে গত ২৩ নভেম্বর৷পরে আদালতের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের কারা জড়িত, অপহৃতদের উদ্ধারে গাফিলতি ছিলো কিনা- এ বিষয়গুলো দেখতে আদালত এই অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল, এটি হত্যাকাণ্ডের মূল তদন্ত টওতিবেদন নয়৷
এই প্রতিবেদন বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না৷ গোয়েন্দা পুলিশ যে চার্জশিট দেবে, যেভাবে আদালতে তুলবে, তার ভিত্তিতেই বিচার হবে৷সাত খুনে জড়িত অন্য যাদের নাম র্যাবের প্রতিবেদনে এসেছে, সেই তালিকাও পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল৷
এরা হলেন- এসআই পূর্নেন্দু বালা, এবি আরিফ হোসেন, নায়েক নাজিম, নায়েক দেলোয়ার, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আব্দুল আলিম, সৈনিক আলামিন, সিপাহী তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, কনস্টেবল আলামিন, হাবিলদার এমদাদ, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সৈনিক আসাদ, সার্জেন্ট এনামুল, এএএসআই বজলু, হাবিলদার নাসির, সৈনিক তাজুল৷নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১ তে কর্মরত এই র্যাব সদস্যের ‘উপস্থিত থেকে হত্যাকাণ্ডে ‘সহায়তা’ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন৷ পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷এর পরপরই র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠে৷ নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র্যাব কর্মকর্তারা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলাও করেন তারা৷
এরপর হাই কোর্ট র্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়৷ ওই তিনজনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে এনে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠায় সরকার৷
পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন৷র্যাব সদর দপ্তর ওই ঘটনা সম্পর্কে জানত কি-না এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এটা দাখিল করেছি, সদরদপ্তর জানত কি-না সম্পূর্ণ প্রতিবেদন পড়ার পরই তা বোঝা যাবে৷
সরকারের শীর্ষ এই আইন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেদন পেয়ে আদালত মন্তব্য করেছেন, এটা যেদিন চূড়ান্ত হলো, তারপরেও অনেকে অপরাধ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে কাগজে এসেছে৷ আমি বলেছি, এটাতো তদন্ত সংস্থা না৷ প্রাথমিকভাবে যারা জড়িত বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তাদের নামই এখানে এসেছে৷আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগে সাত খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তারেক সাঈদ দাবি করেছিলেন, ছয় কোটি টাকা নেয়ার অভিযোগ গণমাধ্যমের সৃষ্টি’৷
স্বীকারোক্তির খবর যেভাবে গণমাধ্যমে এসেছে তার সমালোচনা করে র্যাবের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়৷এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, র্যাবের ওই সময়ের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি অবগত নন৷গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়৷ ৩০ এপ্রিল ও ১ মে শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের মরদেহ পাওয়া যায়৷সাত খুনে জড়িত বলে অভিযোগ আসায় গত ৫ মে বিচারপতি মোহাম্মদ রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্ব-প্রণোদিত হয়ে র্যাব ১১ এর ওই তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন এবং র্যাবকে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন৷ র্যাবের কোনো সাবেক বা বর্তমান সদস্যের সংশ্লিষ্টতা আছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে ওই তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত৷
তারই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার হন তারেক সাঈদ, রানা ও আরিফ৷ এর আগেই তিনজনকে নারায়ণগঞ্জ র্যাব থেকে সরিয়ে এনে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়৷হাইকোর্টের নির্দেশে ৮ মে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি আফতাব উদ্দিনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে র্যাব৷ কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন র্যাব-১০ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারওয়ার, মেজর মোহাম্মদ সাদিক ও এসপি সাজ্জাদ৷ কমিটি সাত মাস ধরে তদন্ত চালিয়ে তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছেন৷ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে তিন দফা অগ্রগতি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে সংস্থাটি৷
র্যাব জানায়, কমিটি এই দীর্ঘ তদন্তকাজে শতাধিক র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে৷ একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাধারণ মানুষ, প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার শিকার সাত জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে৷ এছাড়াও সাত জনকে অপহরণের পর খুন করার আগে সেসব স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় সেগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে তথ্য ও আলামত নিয়েই তার ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পন্ন করে তদন্ত কমিটি৷
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় গঠিত সার্বিক তদন্ত কমিটিতে নতুন প্রধান নিয়োগের আদেশ নাকচ করেছে হাই কোর্ট৷বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ বুধবার এক আদেশে বলেছে, শুরু থেকে সাত সদস্যের এই কমিটির প্রধান হিসাবে কাজ চালিয়ে আসা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মোল্লাকেই প্রতিবেদন দিয়ে বাকি দায়িত্ব শেষ করতে হবে৷
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন৷ পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷অপহরণের ঘটনার পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়৷ নূর হোসেন র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন৷
এরপর র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে হাই কোটের্র নির্দেশে গত ৭ মে এই তদন্ত কমিটি করে সরকার৷ শাহজাহান মোল্লা ওই তদন্ত কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পান৷তার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গত সাত মাসে চার শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নেয়, যাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াত্ আইভী, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানও রয়েছেন৷
এরই মধ্যে গত ৯ নভেম্বর শাহজাহান মোল্লাকে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের (পিএসসি) ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে কমিটির কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়৷এ কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল হাকিমকে মঙ্গলবার কমিটির প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ সরকারের ওই আদেশের পর তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব আবুল কাশেম মহিউদ্দিন বলেছিলেন, তাদের কাজ প্রায় শেষ৷ যে কোনো সময় আদালতে প্রতিবেদন দেবেন তারা৷তদন্ত শেষের পথে থাকলে এই পর্যায়ে এসে কেন কমিটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হচ্ছে সে প্রশ্ন তুলেই আগের প্রধানকে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে বলেছে আদালত৷
নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও হত্যার ওই ঘটনায় প্রশাসনের কেউ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- গণতদন্তের মাধ্যমে তা উদঘাটনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিটিকে৷অপহৃত ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অবহেলা বা গাফিলতি ছিল কি না- কমিটিকে তাও খতিয়ে দেখতে বলেছে আদালত৷