দৈনিকবার্তা-লালমনিরহাট, ৪ ডিসেম্বর: লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনেই ছিটমহলবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হবে এমনটিই আশা করা যাচ্ছে৷ ভারত সরকার তার সংসদে ছিটমহল বিনিময় ইস্যু সংক্রান্ত স্থল সীমান্ত চুক্তিটির অনুমোদন দেবেন বলে আশা করছেন ছিটমহলবাসী৷ আর এটি ভারত সরকার অনুমোদন দিলেই বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় অংশে থাকা ৫১ হাজার মানুষের ভাগ্যে জুটবে নাগরিকত্ব৷ তারা পাবেন একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হওয়ার সব সুযোগ-সুবিধা৷এ দিকে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে সব আপত্তি তুলে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার৷ মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র গত সপ্তাহের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার চায় ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টির সমাধান হোক৷ সরকারি সূত্রের খবর চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময়ে নীতিগতভাবে কোনো আপত্তি নেই রাজ্য সরকারের৷ তবে ছিটমহলের যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে, সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অথের্র প্রয়োজন৷ রাজ্য চায় সেই আর্থিক দায়িত্বের পুরোটাই নিক কেন্দ্র৷
উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে আজ বৃহস্পতিবার কোচবিহারের জনসভায় রাজ্য সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷সূত্র জানায়, এর আগে বেশ কয়েকবার আশ্বাসের পরও ছিটমহল বিনিয়ম সম্ভব হয়নি৷ কারণ ভারত সরকার তার সংসদে এই বিলটির অনুমোদন দিতে ব্যর্থ হন৷ তবে এবার এটি হবে বলে সমপ্রতি নেপালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন৷ এর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে শীতকালীন, বাজেট এবং বর্ষাকালীন অধিবেশনে এটির অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি৷ ফলে ছিটমহলবাসী ভারতের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন৷ তারা এখনো ভারতের দিকেই তাকিয়ে আছেন৷ কেননা, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আপত্তি নেই৷ ভারত সরকার সংসদ থেকে বিলটি পাস করলেই সমাধান হবে বহুল আলোচিত ছিটমহল সমস্যার৷
সূত্র জানায়, ছিটমহল শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু নাগরিকের রাতারাতি দেশহীন হয়ে পড়ার গল্প৷ আছে নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার ও জীবনের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ার গল্প৷ ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে ছিটমহল সমস্যা তৈরি হয়৷ এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এ নিয়ে কথা বললেও প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন হয়নি৷ সেই ১৯৫৮ ও ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও এতে কোনো সময় বেঁধে দেয়া ছিল না৷ ১৯৯২ সালে খালেদা-নরসিমা রাও আবার চুক্তি করেন৷ কিন্তু সে সময়ও চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ে কোনো সময় বেঁধে না দিয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়৷ সর্বশেষ ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে বিষয়টি আবারো আলোচনায় আসে৷ কিন্তু শুধু তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা এবং সেখানকার ছিটমহলের বাসিন্দাদের চলাচলের সাময়িক অসুবিধা দূর হলেও শেষ হয়নি ছিটমহলবাসীর কষ্ট৷ তবে সে সময়ের পর ছিটমহলবাসীর জনসংখ্যা গণনার কাজ শুরু এবং শেষ হয়৷ বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে৷ ভারতীয় ছিটমহলের বর্তমান জনসংখ্যা ৩৭ হাজার৷ বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোতে বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ হাজার৷
সূত্র জানায়, এর আগে অনেকবারই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা হয় কিন্তু এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি৷ তবে, একবার তত্কালীন কংগ্রেস সরকার স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটির অনুমোদন দেয়ার জন্য সংসদে তোলার চেষ্টা করে৷ কিন্তু আসামের দুই এমপির তুমুল আপত্তির কারণে সেটি ভেস্তে যায়৷ তবে, এবার তেমন কোনো ঘটনা ঘটবে না এবং ছিটমহল বিনিময়ের জন্য যে স্থল সীমান্ত চুক্তিটির অনুমোদন দরকার সেটি হবে বলে মনে করেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ-সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত৷ তিনি বলেন, এবার আশা একটু বেশিই করছি৷ তিনি এই চুক্তি অনুমোদনের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন৷ তিনি বলেন, ভারতের নিজের প্রয়োজনেই এবার ভারত তার চুক্তিটি করবে৷ কেননা ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশের বাংলাদেশের বড় ভূমিকা রয়েছে৷ তবে ভারত সরকার ঠিক যে কারণেই এই চুক্তির অনুমোদন করুক না কেন এতে লাভবান যেমন হবে দুই দেশ তেমনি ভাগ্য বদল হবে ছিটমহলবাসীর৷ আর সেই আশায় তারা ক্ষণ গুনছেন৷ ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দা (যা অনুমোদন পেলে ভারতের অংশ হবে) জয়নাল আবেদীন জানান, তাদের ওখানে জনগণ মসজিদে মিলাদ করে দোয়া পড়েছে যেন এবার আর ভারত সরকার পিছিয়ে না পড়ে, কথা অনুযায়ী ঠিক সময়েই চুক্তিটির অনুমোদন হয়৷
আনন্দবাজার জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানাজির্র জনসভার জন্য ছিটমহল লাগোয়া কোনো মাঠ বাছার নির্দেশ এসেছিল সপ্তাহ খানেক আগে৷ নেত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তার বহর অক্ষুণ্ন থাকে, প্রত্যন্ত এলাকায় এমন মাঠ বাছতে ঘাম ছুটে যায় প্রশাসন ও জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের৷ কিন্তু তখনই স্পষ্ট হয়েছিল, জনসভায় ছিটমহল নিয়ে কোনো বড় খবর ঘোষণা করতে চান মমতা৷ শেষ পর্যন্ত কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকা ডাকুর হাটকে তার জনসভার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে৷ এখানে তার মঞ্চের শ’দেড়েক মিটার পেছনেই বাংলাদেশি ছিটমহল করলা৷
তার বক্তৃতা শুনতে যে ছিটমহলের বাসিন্দারাও আসবেন, মমতা তা বিলক্ষণ জানেন৷ থাকবেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি৷
লোকসভা নির্বাচনের আগে কোচবিহারের জনসভাতেই মমতা প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ছিটমহল নিয়ে তিনি অবস্থান বদলাচ্ছেন৷ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চান বাসিন্দাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করে ছিটমহল বিনিময় হোক৷
বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম সেপ্টেম্বরে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার কাছেও ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন মমতা৷ সমপ্রতি নবান্নে বাংলাদেশের এমপিদের একটি দলের কাছেও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, অসুখ হলে ডাক্তার-হাসপাতাল নেই, পড়াশোনার স্কুল-কলেজ নেই, থানা-পুলিশ নেই, নাগরিকত্বের পরিচয়টুকুও নেই ৬৫ বছর ধরে এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ৷ ভাবা যায়?
গত সপ্তাহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থল সীমান্ত চুক্তির খসড়াটি অনুমোদিত হয়৷ তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি সুগত বসু ও মমতাজ সংঘমিতা এতদিন বিরোধিতা করে এলেও এই বৈঠকে চুক্তির পক্ষেই সায় দেন৷
সংবাদদাতা/জিএম/ফোকাস বাংলা/১৮৩২ ঘ.
