দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২ডিসেম্বর: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্য করায় সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আনা আদালত অবমাননার অভিযোগে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷ এ অর্থ অনাদায়ে তাকে ৭ দিনের জেল ভোগ করতে হবে৷মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় দেয়৷
মঙ্গলবার ট্রাইবু্যনালের কার্যক্রম চলা পর্যন্ত ডেভিড বার্গম্যানকে এজলাস কক্ষে বসে থাকারও নির্দেশ দেয়া হয়৷ একই সঙ্গে ডেভিড বার্গম্যান কিভাবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করছেন তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদেও প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল৷আগামী সাতদিনের মধ্যে ট্রাইবু্যনালের রেজিস্ট্রার অফিস বরাবর জরিমানাকৃত অর্থ দিতে হবে৷ অনাদায়ে তাকে সাতদিনের কারাদন্ড ( জেল) ভোগ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়৷ রায়ের দিন তাকে আদালতে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এই ব্রিটিশ নাগরিককে৷ জরিমানার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাকে সাত দিনের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে৷রায়ে ট্রাইব্যুনাল ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত বিষয়ে ভবিষ্যতে সমালোচনামূলক লেখা না লিখতে বার্গম্যানকে সতর্ক করে দিয়েছে৷
ব্লগে দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখার মাধ্যমে বার্গম্যান বিচারাধীন বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ট্রাইবু্যনালকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়৷ ডেভিড বার্গম্যান ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি৷ তিনি সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের মেয়ে আইনজীবী সারা হোসেনের স্বামী৷ রায় ঘোষণার সময় সারা হোসেনও আদালতে উপস্থিত ছিলেন৷
বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ট্রাইবু্যনালে এই আবেদন করেন হাই কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ৷ পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সাঈদ মিজান৷আদালতে শুনানিতে তিনি বলেন, ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি আজাদ জাজমেন্ট অ্যানালাইসিস-১, ইন অ্যাবসেন্সিয়া ট্রায়াল অ্যান্ড ডিফেন্স ইনডিকোয়েন্সি’ এবং আজাদ জাজমেন্ট অ্যানালাইসিস-২, ট্রাইব্যুনাল অ্যাজাম্পশন শীর্ষক লেখা প্রকাশ করেন৷
এসব লেখায় ট্রাইবু্যনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আবুল কালাম আযাদের রায় নিয়ে করা মন্তব্যেও ট্রাইবু্যনালের মর্যাদাহানী হয়েছে বলে আবেদনে অভিযোগ করা হয়৷সাঈদ মিজান শুনানিতে বলেন, ডেভিড বার্গম্যান ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার আগেই সেই রায় নিয়ে মন্তব্য করেছেন৷ এছাড়া বিচারাধীন বিষয় নিয়েও তিনি মন্তব্য করেছেন তার লেখায়৷ এসব মন্তব্য বিচারিক আদালতের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং জনস্বার্থবিরোধী৷ এগুলো রায় নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং ‘জাতীয় অনুভূতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ ডেভিড বার্গম্যানের ব্লগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় নিয়ে করা মন্তব্যেও আদালত অবমাননা হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়৷
মিজান পরে বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগে ট্রাইবু্যনাল বলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়, দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়৷ ডেভিড বার্গম্যান তার ব্লগে লিখেছেন, ট্রাইবু্যনালের দেওয়া এসব তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই৷গত ১৮ মার্চ আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা ট্রাইবু্যনালে দাখিল করেন ডেভিড বার্গম্যান৷ তাতে সন্তুষ্ট না হওয়ায় ট্রাইবু্যনাল ১৭ এপ্রিল তাকে আবারো জবাব দাখিল করতে বলে৷
২৫ অগাস্ট বার্গম্যানের পক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো দাখিল করা জবাবের বিষয়ে শুনানি করেন তার আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান৷ আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মিজান সাঈদ৷গত ৪ সেপ্টেম্বর ট্রাইবু্যনালে এ বিষয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষ হয়৷ প্রসিকিউটরদের মধ্যে জেয়াদ আল মালুম এবং তুরিন আফরোজ শুনানিতে ছিলেন৷যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে লেখালেখির জন্য বিচারপ্রার্থী আন্দোলনের কর্মীদের কাছেও সমালোচিত বার্গম্যান৷এর আগে ২০১১ সালে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ এ মতামত কলামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় ডেভিড বার্গম্যানকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছিল ট্রাইবু্যনাল৷
এর আগে ২০১১ সালের ২ অক্টোবর ‘এ ক্রুশিয়াল পিরিয়ড ফর আইসিটি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদালত অবমাননার অভিযোগে তখনকার প্রতিবেদক ডেভিড বার্গম্যান, নিউ এইজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং প্রকাশক আ স ম শহীদুল্লাহ খানকে কারণ দর্শাতে বলে ট্রাইবৃ্যনাল৷শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ডেভিড বার্গম্যানকে সর্বোচ্চ সতর্ক করে আদেশ দেয়া হয়৷ সে সময় আদালত অবমাননা হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইবু্যনাল শুধুমাত্র ভাবমূর্তির বিবেচনায় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন৷
এদিকে, ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানকে দণ্ড দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন৷ তিনি বলেছেন, ট্রাইবু্যনালের এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর চরম আঘাত৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি হচ্ছে স্বাধীনভাবে মুক্ত চিন্তার চর্চা করা ও ভিন্নমত সহ্য করে নেয়া৷ ভিন্ন মত যদি থাকে, থাকলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার সংবিধান স্বীকৃত৷ খুবই দুঃখের বিষয়, এই আদালত আজকের এই রায়ে বাকস্বাধীনতাকে কোনোভাবেই সংরক্ষণ করে না৷ বরঞ্চ বাক স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে৷মঙ্গলবার ডেভিড বার্গম্যানকে ট্রাইব্যুনাল-২ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং মামলা চলাকালীন আদালতে বসে থাকার সাজা দেন৷ ধার্যকৃত টাকা অনাদায়ে সাত দিনের দণ্ড ঘোষণা করেন৷এ রায়ের পর বার্গম্যানের স্ত্রী ও বিশিষ্ট আইনজীবী গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনে মেয়ে সারা হোসেন বলেন, যারা এখানে সংবাদকর্মী আছেন তাদের প্রথমেই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত, সাংবাদিকরা কি কিছু বলতে পারবে না, কিছু করতে পারবে না৷
তিনি বলেন,অবমাননার আইন দিয়ে এভাবে রুদ্ধ করে, আপিলের সুযোগ থাকবে না,যেটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত না, এসব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে ভালো চোখে দেখায় না৷ বিদেশি নাগরিকদের কাছে আমরা আমাদের অধিকার রাখতে পারছি কি না৷ সবকিছু যে কোর্টের আইন দিয়ে বেঁধে দেয়া সাংবিধানিক কিনা, অবমাননা হবে এবং এখানে আপিলের সুযোগ থাকবে না, প্রশ্ন তোলার জায়গা থাকবে না, সেটা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে অধিকারটুকু আদায় করতে পারবে কিনা তা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ডেভিড বার্গম্যানের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়ে সারা হোসেন বলেন, এটা ট্রাইবু্যনালে এখতিয়ার না৷
তিনি বলেন, কারো নাগরিকত্ব দেখা না দেখা এটি তাদের কাজ না৷ তারা যদি হুমকি দিতে চায়, বাংলাদেশি একজন নাগরিকের স্বামী, তার অধিকার থাকবে না এদেশে থাকার, এদেশে কথা বলার, তাহলে আমি এ ব্যাপারে চরম, চরম, চরম আপত্তি জানাচ্ছি৷সারা বলেন, মনে হচ্ছে এদেশে দুই ধরনের নাগরিক আছে, যারা অন্য দেশের নাগরিককে বিয়ে করতে পারবে, ঢাল তলোয়ার পরে আছে৷
তিনি বলেন, উচ্চতর পর্যায়ে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবেন, তাতে কোনো অসুবিধা নাই৷ কিন্তু যারা সরকারের কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি হবে৷এই আইনজীবী বলেন, এ সরকারের কোনো কাজ নিয়ে সমালোচনা করলেই সেটা উনি ( ডেভিড বার্গম্যান) , আমি বা অন্য যে কেউ হোক আপনারা সবাই ভালো বুঝছেন তার ওপরে কেন আক্রমণ আসছে৷