santu-larma_181561

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৯ নভেম্বর: আগামী ৩০এপ্রিল সরকারকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের সময় বেধে দিয়েছে জনসংহতি সমিতি, না হলে ১মে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি৷শনিবার সকালে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা৷

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, কেন্দ্রীয় নেতা দীপায়ন খিসা এবং রাজশাহীর আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন৷ উপস্থিত ঐক্য ন্যাপের সভাপতি এবং রাজশাহী আদিবাসী নেতা রবীন্দ্রনাথসহ অন্যরা অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন জানান৷সংবাদ সম্মেলনে আলটিমেটাম দিয়ে সন্তু লারমা বলেন, চুক্তি পরিপন্থি জুম্মস্বার্থ বিরোধী সব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ জোরদার করা হবে৷

তৃতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও শান্তিচুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষুব্ধ আদিবাসী নেতারা৷ এতে করে পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের৷১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ওই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে আদিবাসী সংগঠন জনসংহতি সমিতি৷পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে এনে আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠাই এ চুক্তির মূল লক্ষ্য৷

চুক্তি স্বাক্ষরের ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এর মূল ধারাগুলোর বেশিরভাগই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ করেন জনসংহতি সভাপতি সন্তু লারমাএ রকম বাস্তবতায় রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে চুক্তি বস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি৷

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধানের আহ্বান জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এ সভাপতি৷লিখিত সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা বলেন- ঢাকা, চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলা ও উপজেলা সদরে র্যালি, গণসমাবেশ ও আলোচনা সভা আনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ পার্বত্যবাসীসহ দেশবাসীকে জনসংহতি সমিতির সেই কর্মসূচিতে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি৷

পর্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা৷বস্তুত সামগ্রিক স্বার্থেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ তাই এ চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের দায়িত্বই প্রধান৷ এ অবস্থায় আর বিলম্ব না করে চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ নিতে সমিতি সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে৷ অন্যথায় চট্টগ্রামে যে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে৷সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পার হতে চলেছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল৷ আশা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা টওবর্তনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে৷ এর মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী আধিবাসীরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করবে৷ কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের ১৭ বছরেও চুক্তির যথাযথ বাস্তায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কাঙ্খিত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত হয়নি৷

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকার কেবল চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বছরের পর বছর ধরে অবাস্তবায়িত রেখে চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য, বিভ্রান্ত্রিমূলক ও মনগড়া তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে৷ চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে চুক্তি পরিপন্থি ও জুম্মস্বার্থ বিরোধী আইন প্রণয়ন এবং কার্যক্রম হাতে নিয়ে চলেছে৷ চুক্তির অবাস্তবায়িত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিয়ে সরকার উল্টো চুক্তি লংঘন করে চলেছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে আইন প্রণয়নের বিধান রয়েছে৷ সেই বিধি-বিধানকে পদদলিত করে একতরফাভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন তৈরি এবং রাঙ্গমাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে৷এছাড়া বিভিন্ন আইন পাশের কথাও বলেন সন্তু লারমা৷

সন্তু লারমা অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক৷ সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নে অব্যাহত গড়িমসি ও কায়েমি স্বার্থবাদিদের ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে ঘাপটি মেরে থাকা সামপ্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের অপতত্‍পরতা চালিয়ে যাচ্ছে৷ এসব অপশক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে পশ্চাদভূমি হিসেবে ব্যবহার করে সারাদেশে মৌলবাদী তত্‍পরতা ও জঙ্গি তত্‍পরতা বিস্তৃত করে চলেছে৷

সন্তু লারমা অভিযোগ করে বলেন, বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক আমলা নির্বিচারে জায়গা দখল করছে৷ নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলায় ২১টি চাক পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রাক্তণ ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ জলাভূমি দখল করেছে৷ লামা উপজেলায় আনিসুর রহমান ও মোঃ মোহসিন বাদল (লাদেন গ্রুপ খ্যাত) ৭৫টি ম্রো, ত্রিপুরা মারমা ও স্থায়ী বাঙালি পরিবার উচ্ছেদ করে ১৭৫ একর জমি দখল করেছে৷ মুজিবুল হক গং মারমা গ্রামবাসীর উপর হামলা চালিয়ে টওায় ৫০০ একর জায়গা দখল করেছে৷ রোয়াংছড়ি উপজেলায় মোঃ সামাদ আলী নামের বহিরাগত ৩৩টি মারমা পরিবারের রেকর্ডিয় সম্পত্তি জাল করে বন্দোবস্তকরণ ও জবরদখলের চেষ্টা করছে৷ আলিকদম উপজেলায় বদিউল আলম গং ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারের এক হাজার একর রেকর্ডিয় ও ভোগদখলীয় জমি জবরদখল করেছে৷

সন্তু লারমা বলেন, প্রশাসনে ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপডিএফ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সংস্কারপন্থি নামে খ্যাত বিপথগামী গোষ্ঠী অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাসহ সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে৷ চুক্তি স্বাক্ষরের পর এ পর্যন্ত ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থি সন্ত্রাসীরা ৯৩ জন সদস্যসহ ৩ শতাধিক খুন ও নিরীহ লোকজনকে অপহরণ-নির্যাতন করেছে৷ সমপ্রতি পাহাড়ে ও সমতলে ১৬ জন আদিবাসী নারী যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমা বলেন, গত আগস্টে বিচিত্রা তির্কির মতো একজন নির্বাচিত ইউপি সদস্য ও পদকপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধির উপর হামলা ও যৌন সহিংসতার ঘটনায় হামলাকারিরা নির্বিঘ্নে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে৷ যে কারণে আদিবাসীরা উদ্বিগ্ন৷

সন্তু লারমা সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে সরকার৷ সরকারের আলামত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নে আর কার্যকর পদক্ষেপ নেবে না৷ চুক্তি বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম হাতে নেবে৷ যার মূল উদ্দেশ্যই হলো আদিবাসী জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা৷সন্তু লারমা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, পার্বত্য (শান্তি) চুক্তি বাস্তবায়নে আগামী ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে৷