দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ,২৭ নভেম্বর: ২০২১ নয়,২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)৷স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর অ্যাঙ্কটাডের তৈরি ২০১৪ সালের প্রতিবেদন প্রকাশকালে সিপিডির সম্মনিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে এ মূল্যায়ন করেন৷
বৃহস্পতিবার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর তৈরি ২০১৪ সালের আংকটাডের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিপিডি৷ অনুষ্ঠানে আংকটাডের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান৷ উপস্থিত ছিলেন সিপিডি এর সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. গোলাম মোয়জ্জেম, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহামনসহ আরো অনেকে৷ আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না এ জন্য কমপক্ষে এক দশক সময়ের প্রয়োজন৷অ্যাঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,স্বল্পোন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে উন্নতি করলেও মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট নয়৷তবে স্বল্পোন্নত ৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র তুলনামূলক ভাল বলেও এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷২০১২ সালে নির্ধারিত সূচক অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত ৪৮টি দেশ কতটা উন্নয়ন করতে পেরেছে তার উপর নির্ভর করে আগামী বছর নির্ধারণ করা হবে কারা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে৷
সে চিত্র অনুযায়ী নির্ধারিত তিনটি সূচকের মাত্র একটিতে বাংলাদেশ সাময়িকভাবে লক্ষ্য পুরণ করতে সক্ষম হয়েছে৷ মধ্যম আয়ে পরিণত হতে ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিঁছু আয় হতে হবে ১২৪২ ডলার৷ বর্তমানে মাথাপিঁছু আয় ১১৯০ ডলার৷ অর্থনৈতিক নাজুকতা সূচকে ৩২ দশমিক চার থেকে কমিয়ে ৩২ এ নিয়ে আসতে হবে৷ আর মানব উন্নয়ন সূচকে ৫৪ দশমিক সাত কে বাড়িয়ে ৬৬তে উন্নীত করতে হবেবলে জানান সিপিডির ফেলো ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান৷২০১৫ সালের পর আবার এসব সূচক নতুন করে নির্ধারণ করা হবে৷ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার জন্য প্রতিটি সূচকের লক্ষ্যমাত্রাই সেখানে বেড়ে যাবে৷ আর এই বাড়তি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য৷
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন,স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে হলে প্রথমে ৬ বছরের জন্য সে দেশকে মূল্যায়ন করা হয়৷ কারণ দেশটির যে অগ্রগতি, তা কতোটা স্থায়ী না ভঙ্গুর সেট পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ তারপরই সে দেশটি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে পারে৷ ২০১৫ সালে যে দেশগুলোকে এভাবে মূল্যায়নের তালিকায় রাখা হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই৷ অর্থাত্ ২০২১ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া হচ্ছে না বাংলাদেশের৷ তবে বাংলাদেশ সব ধরনের সূচকে সবচেয়ে দ্রুত সময়ে অগ্রগতি আনলেও ১ দশকের আগে সল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে পারবে না৷
তিনি বলেন,আমরা মধ্য আয়ের দেশে খুব সহজেই পৌঁছতে পারি৷ তাই বলে সেটা আমাদের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের করে নিয়ে অসতে পারবে না৷ কারণ শুধুমাত্র জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলেই মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছা সম্ভব৷ তাছাড়া স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হতে আমাদের অপ্রচলিত পদ্ধতিতে বের হয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য৷তিনি আরো বলেন,তিনটি সূচক রয়েছে-মাথাপিছু আয়,মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত ভঙ্গুরতা৷ এ তিনটির প্রথম এবং যে কোনো একটিকে সাথে নিয়ে অন্যদেশগুলো বের হয়ে এলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নকে তরান্বিত করার মধ্য দিয়ে এখান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব৷ কারণ বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় নিভর্র করে বের হওয়া খুব কঠিন বলে মনে করেন তিনি৷২০২১ এর মধ্যে এখান থেকে বের না হওয়ার কারণ হিসেবে দেবপ্রিয় বলেন, আন্তর্জাতিক যে পরিমান সহযোগিতা এ দেশগুলো পাওয়ার কথা ছিল তা তারা ঠিকঠাক পায়নি,কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে৷ যেখানে এখনো কর্মসংস্থানে কৃষির অবদান ৫০ শতাংশের ওপরে৷
এদিকে বাংলাদেশেরএখান থেকে বের হতে হলে সবার আগে রপ্তানিতে একটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা না রেখে,অন্য যেসব সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে সেগুলোতে বিশেষ করে নজর দিতে হবে৷ তাছাড়া বাংলাদেশ শ্রমের উত্পাদনশীলতার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বলে তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে৷তবে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যাদের অগ্রগতি সববেচেয়ে ভালো তার প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ৷ তাছাড়া সবচেয়ে সফল হচ্ছে রুয়ান্ডা, এরপরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ এবং কম্বোডিয়া৷দেবপ্রিয় বলেন,বাংলাদেশেকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রয়োজন স্বয়ংক্রিয় শিল্পনীতি ও সক্ষম মুদ্রানীতি৷দেশে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় অন্যদের তা দেওয়া হয় না৷ শুধু প্রভাবশালীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সম্ভাবনাময় খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ পাশাপাশি অগ্রাধিকার খাতে নীতি-সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে৷ রাজস্ব আয় ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে সম্পদ বন্টনের দিকে নজর দিতে হবে৷
তিনি বলেন,স্বল্পোন্নতদেশগুলোসামপ্রতিক সময়ে যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে৷এরমধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য৷ দক্ষিণ এশিয়ার দু-একটি দেশের নাম বললে এরমধ্যে বাংলাদেশের নাম অবশ্যই আসবে৷ মূলত ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার পর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি বেশ বেড়ে গেছে৷ তবে যে সময় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি এগিয়ে যাচ্ছে সেসময় দেশগুলোর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনীতির বহুমুখীকরণ হচ্ছে না৷ এতে দেশগুলো অর্থনৈতিক দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে৷
সিপিডির সম্মানিত এই ফেলো বলেন,এমডিজির (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে অনেক পিছিয়ে আছে৷ অগ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান অনেক বৃদ্ধি পেলেও প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি৷ বাংলাদেশের কর্মসংস্থান এখন কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে৷ কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৫৪ শতাংশ৷ অথচ জিডিপিতে ( মোট দেশজ উত্পাদন) কৃষির অবদান মাত্র ১৭ শতাংশ৷ অর্থাত্ যে সংখ্যক মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত সে হারে জিডিপিতে এই খাতটি অবদান রাখতে পারছে না৷
অপরদিকে রফতানি আয় বাড়লেও তা একটি পণ্যকে কেন্দ্র করে হচ্ছে৷ অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বাড়ছে না৷ মাঝে মধ্যে যা বেড়েছে তা দাম উঠানামার কারণে৷ উত্পাদন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কম মজুরি, কম উত্পাদশীলতার মধ্যে রয়েছে৷ ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়া হচ্ছে তার একটি বড় অংশ খেলাপিতে থেকে যাচ্ছে৷ অর্থাত্ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ উত্পাদশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না৷ এ পরিস্থিতি বাংলাদেশকে ভঙ্গুরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷দেবপ্রিয় আরও বলেন,বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে৷এ আয় বাড়ার কারণ রেমিটেন্স বৃদ্ধি ও টাকার মান বৃদ্ধি পাওয়া৷ তবে শুধু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে ভঙ্গুরতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না৷ বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে৷ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণের মতো অপ্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে৷ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া সম্পদ রফতানি করা যেতে পারে৷ কিন্তু এতে কাঠামোগত পরিবর্তন হবে না৷
অন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে যে ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথা দিয়েছিলো তা তারা দেয়নি বলেও মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য৷মূল প্রতিবেদন প্রকাশকালে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে৷ গত এক দশকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর যে অগ্রগতি হয়েছিলো তাতে ভাটা পড়েছে৷ এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ২০১৫ পরবর্তী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে৷ কৃষিখাত থেকে শ্রমিক বের করে শিল্পখাতের দিকে নিয়ে যেতে হবে৷ কৃষিখাত থেকে শ্রমিক বের করে যত বেশি শিল্পখাতে ব্যবহার করা যাবে উত্পাদশীলতা তত বাড়বে৷
গবেষণা তথ্য তুল ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ২০১৫ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৪২ ডলার হতে হবে৷ ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৯০০ ডলার৷ বর্তমানে ৯৯২ ডলার৷ ২০১৫ সালে এটি বেড়ে এক হাজার ৩৫ ডলার হতে পারে৷ মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক ৬৬ হতে হবে৷ তবে ২০১৫ সালের মধ্যে এই সূচক বড়জোর ৬০ হতে পারে৷ সুতরাং ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না৷ ২০১৫ সালের মধ্যে যে দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে জাতিসংঘ বলছে, তার মধ্যেও বাংলাদেশের নাম নেই৷
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,এমডিজি’র যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা খুব কমসংখ্যক দেশ অর্জন করতে পারবে৷ এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ পরবর্তী যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করতে না পারলে এসডিজি’র (স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করা সম্ভব হবে না৷
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বল্প সুদে যে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে আসলে তা বাণিজ্যিক সুদে নিতে হবে৷ তবে এখই অনেকক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সুদে ঋণ নিচ্ছে৷ তাই স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে আসলে ঋণ পেতে যে অসুবিধা হবে, এমন ধারণা ঠিক না৷