দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩নভেম্বর: বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তিকে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার আকাঙ্খক্ষা পূরণে বাংলাদেশের উন্নয়নে জনশক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷ রোববার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়পরিদর্শনকালে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী৷প্রবাসীদের জন্য বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন কল্যাণমূলক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনশক্তি রপ্তানি কর্মকাণ্ড তথপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে৷ ফলে ২০ লাখ শ্রমিক ডাটাবেজের আওতায় এসেছে৷ প্রত্যেক প্রবাসী শ্রমিকের জন্য বায়োমেট্রিক স্মার্ট কার্ড চালু হয়েছে৷
তিনি বলেন,’আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে চৌকস কূটনৈতিক তত্পরতায় মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক বৈধতা পায়৷ কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি শাসনামলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় ১ লাখ বাংলাদেশি অবৈধ হয়ে পড়ে৷ শেখ হাসিনা বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ভালোভাবে কাজ করছে৷ এ ব্যাংক থেকে একজন বিদেশে চাকরি প্রার্থী তার বিমান ভাড়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য ঋণ নিতে পারে৷
সরকার জনশক্তি খাতে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় এবং প্রবাসী চাকরিজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী শ্রমিক আইন ২০০১ প্রণয়ন করেছে৷বিদেশে চাকরির নামে লোক পাঠিয়ে প্রতারণা ঠেকানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ কোনো ধরনের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ যাতে কাজের জন্য বিদেশে না যায় সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কর্মসূচি গ্রহণেরও তাগাদা দিয়েছেন সরকার প্রধান৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই জনশক্তির প্রয়োজন আছে৷ সেসব জায়গায় আলাপ- আলোচনা করলে আমরা জনশক্তি প্রেরণ করতে পারব এবং দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করতে পারব৷দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ একান্তভাবে দরকার৷ আপনারা সেই প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেবেন৷বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে উন্নীত করার ওপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী৷ আর তা করা গেলেই কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি৷
শেখ হাসিনা বলেন, কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষ মনে করে এই জনসংখ্যা আমাদের জন্য বিশাল একটা সমস্যা৷ আমি বক্তিগতভাবে মনে করি, এটা আমাদের জন্য সমস্যা নয়, বরং এটা আমাদের একটা সম্পদ৷ জনশক্তি একটা বড় সম্পদ৷আমরা যদি তাদের কাজে লাগাতে পারি, প্রশিক্ষিত করতে পারি- তাহলে এই জনশক্তিই আমাদের নিতে পারে আমাদের যে লক্ষ্য, সে লক্ষ্যে৷
বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুসারে সেভাবে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে৷ কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী বিভিন্ন দেশে পাওয়া কঠিন৷ কোন দেশে কোন ধরনের লোকের চাহিদা বেশি- সেটাকে একটু নিরূপণ করতে হবে৷আমরা যদি কারিগরি শিক্ষা দিই, তাহলে আমরা স্কিল লেবার পাঠাতে পারব৷ দক্ষ জনশক্তি আরো বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে৷
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ও যুব মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে সব কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে- সেগুলোর সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা- এর একটা সমন্বয় দরকার৷দালালদের ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী৷
তিনি বলেন, কিছু লোক জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা করে৷ তাদের মাধ্যমে চলে যায়৷ কোথায় যাবে, কী করবে, কোন ধরনের কাজ করবে- তার কোনোই ঠিক ঠিকানাই ছিল না৷ তাদের কাজের কোনো নিশ্চায়তা ছিল না৷ চোখে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে পাঠানো হত এবং পরবর্তীতে অনেক সময় তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হত৷ এ ধরনের নানান সমস্যায় আমাদের দেশের মানুষদের ভুগতে হয়েছে৷
আমরা সে জায়গা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাই৷ সেজন্যই আমরা ইতিমধ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি৷তবে এখনো এই সংকটের অবসান ঘটেনি বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী৷এখনো কিছু মানুষ আছে- যারা তাদের ভালো বুঝতে পারে না৷ তাদের যখন মুখরোচক কথা বলা হয়, তখন তারা নিজেদের ভাগ্যের অন্বেষণে যাত্রা শুরু করে৷ তারপর নানা ধরনের বিপদে পড়ে৷ এই অবস্থাগুলো এখনো কিছুটা বিদ্যমান রয়েছে৷সমপ্রতি ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পর সাগর থেকে উদ্ধার বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতো দুর্যোগের ভিতরে মানুষ সাগর পাড়ি দিয়ে কেন যে যেতে চায়- এটাই আমার অবাক লাগে৷
বিদেশে পাঠানোর নাম কওে প্রতারণা ঠেকাতে আরো সতর্কতা ও নজরদারির তাগাদা দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যেন এই সাধারণ মানুষগুলোকে এঙ্প্লয়েট করতে না পারে- সেদিকে একটু নজর দেন৷ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী কর্মী আইন-২০১৩ এবং জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বেড়েছে৷ প্রবাসী কর্মীদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে৷
প্রবাসী কর্মীদের সমস্যার সমাধান ও কাজের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন মিশন খোলা এবং ১৫টি নতুন শ্রম উইং চালু করার কথাও উল্লেখ করেন তিনি৷অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ কর্মীর তথ্যভাণ্ডার প্রস্তুত এবং বিদেশগামী প্রত্যেক কর্মীর ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ বায়োমেট্রিক স্মার্টকার্ড’ প্রচলনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই যে খুশী হবে- তা নয়৷ কিছু লোক তো অখুশী হবে৷ তারা আমার কাছেও এসেছে৷ আমি তাদের বলেছি, ব্যবসা আমরা বন্ধ করতে চাই না৷ ব্যবসা চলবে৷ ব্যবসার নামে তারা সাধারণ মানুষকে এঙ্প্লয়েট করবে-সেটা যেন না হয়৷
সবাই ব্যবসা করে লাভ করতে চায়৷ কিন্তু সে লাভেরও একটা সীমিত অংশ থাকা উচিত৷ কয়েকশ ভাগ লাভ করে গরীব মানুষগুলোকে নিঃস্ব করে দেওয়া- এটা যেন না হয়৷জি-টু-জি পদ্ধতিতে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোয় মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন অতি অল্প খরচে মানুষ যেতে পারছে৷
বর্তমান সরকারের সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি লাভ করেছে৷মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধ করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়াতে এক লাখ ৬৫ হাজার অবৈধ অভিবাসী ছিল৷ আমি তখন নিজে মালয়েশিয়া সফর করি এবং সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বৈধ করার একটা ব্যবস্থা করি এবং তারা বৈধ হয়৷ ঠিক একই অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যেসহ বিভিন্ন দেশে ছিল৷ আমরা আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যের ফলে সকলকেই বৈধ করে দেই৷
সাত বছর পর ক্ষমতায় এসে দেখলাম- মালয়েশিয়াতে দ্বিগুণ লোক অবৈধ হয়ে বসে আছে৷ একটা পর্যায়ে এমন ছিল, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ কথাটা তোলাই যেত না৷ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার কথা তারা বলতেন৷ বিভিন্নভাবে কথা বলে আমাদের যারা অবৈধ ছিল তাদের বৈধ করি৷প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন মালয়েশিয়ার সঙ্গে অত্যন্ত চমত্কার সম্পর্ক৷ এখন আমরা জি টু জি বেসিসে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি৷
বর্তমানে বিশ্বের ১৫৯টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যাদের যে দেশে পাঠাচ্ছি, সে দেশের মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা৷ যে দেশে যাবে, সে দেশের আইন কানুনগুলো জানা- এটা একান্তভাবে প্রয়োজন৷বিদেশে যেখানে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন, সেখানে স্কুল করে দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী৷ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীর আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন৷