দৈনিকবার্তা-বরিশাল, ১৪নভেম্বর: শনিবার ঘূর্ণিঝড় সিডরের ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত ১৫ নভেম্বর৷ ২০০৭ সালের এ দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর৷ ওই দুঃসহ স্মৃতি আজো ভুলতে পারেনি স্থানীয় মানুষ৷এ দিনে উপকূলের লাখো মানুষ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল৷ প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ৷ সহায়-সম্পদ ও স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস৷ সাত বছর আগের এই দিনে সিডরের তান্ডবে লন্ড-ভন্ড হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের ৩০ জেলার দুই শতাধিক উপজেলা৷ বিধ্বসত্ম হয় ৬ লাখ মানুষের বসতবাড়ি-ফসলের ক্ষেত৷ প্রাকৃতিক এই তা-বে ক্ষতিগ্রসত্ম হয় সড়ক, নৌ, বিদু্যত্ এবং টেলিযোগাযোগসহ আধুনিক সব অবকাঠামো৷
বরগুনার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান খান জানান, সেদিন রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে কোনো কিছু বোঝার আগেই হঠাত্ শুরু হয়ে গেল ঘূর্ণিঝড়৷ এর আগে কয়েকদিন ধরেই বিক্ষুব্ধ ছিল প্রকৃতি৷ গভীর সমুদ্রে নিম্নচাপের খবর দিচিছল আবহাওয়া বিভাগ৷ আগেরদিন বিকালে দেয়া হয় ১০ নম্বার মহাবিপদ সঙ্কেত৷ প্রশাসনের উদ্যোগে ও প্রচারণায় সাইক্লোন শেল্টারসহ অন্যান্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয় উপকূলের মানুষ৷ মোটামুটি ভালোভাবেই কাটে রাতটি৷
তিনি বলেন, ঝড় হয়নি দেখে পরদিন সকালে ঘরে ফেরে সবাই৷ অবশ্য তখনো বহাল ছিল সর্বো”চ বিপদ সঙ্কেত৷ বিকাল থেকে বাড়তে থাকে ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি৷ সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় সমুদ্র মাড়িয়ে উপকূলে ধেয়ে আসে সিডর৷ সঙ্গে ছিল তার ১২-১৫ ফুট উঁচু জলোচছ্বাসের তোড়৷
বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন মনোয়ার বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে সিডর৷ সরকারি-বেসরকারি হিসেবে সিডরে ক্ষতিগ্রসত্ম হয় ৩০ জেলার ২০০ উপজেলা৷ সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা বলা হয় ৩৩৬৩ জন৷ তবে বেসরকারীভাবে মৃতের সংখ্যা আরো বেশী দেখানো হয়৷ বরগুনাসহ উপকূলের রাসত্মাঘাট, সেতু-কালভাট, ঘরবাড়ি, গৃহস্থালি, গাছপালা, হাঁসমুরগি, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা সব লন্ডভন্ড করে দেয় সিডর৷
দীর্ঘ সাত বছর অতিবাহিত হলেও অনেকে এখনো স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারেনি৷ অনেকে পারেনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে ৷ প্রতিবছর উপকূলের মানুষ এই দিনটিকে সিডর দিবস হিসেবে পালন করে৷
শনিবার সিডরে স্বজন ও সহায় সম্পদ হারা উপকূলবাসী মিলাদ মাহফিল, দোয়া, কোরআনখানি ও বিভিন্ন পারিবারিক আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে৷ স্থানীয় দুটি কমিউনিটি রেডিও, বেসরকারি লোকবেতার ও সরকারী কৃষি রেডিও প্রচার করবে সিডর স্মৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান৷
বাগেরহাট : প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় \’সিডর\’ আঘাত হানার পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের সংস্কার না হওয়ায় আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না দক্ষিণ জনপদের উপকূলীয় বাসিন্দাদের৷২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব এলাকার বেড়িবাঁধসহ অসংখ্য স্থাপনা৷
প্রলয়ঙ্করী সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর সাত বছরে সহায় সম্বল হারানো মানুষ সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় ইতোমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বন্য নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর সংস্কার ও মেরামত যথাযথভাবে না হওয়ায় বরগুনা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকার মানুষের অনিশ্চয়তা কাটছে না৷
স্থানীয়রা বলছেন, এ দুই জেলায় যেসব বাঁধ আছে সেগুলোর অবস্থা নাজুক৷ বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে তা ঠেকাতে পারবে না এই বাঁধ৷অমাবস্যা-পূর্নিমায় এখনো বরগুনায় বিষখালী ও পায়রা নদী তীরের সদর উপজেলা, পাথরঘাটা ও আমতলীর বিভিন্ন গ্রামে পানি ঢুকে ফসলের ক্ষতি করে৷
সদর উপজেলার বালিয়াতলি গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান বলেন, সিডরের পরে তার এলাকায় বেড়িবাঁধের সংস্কার হয়েছে নামে মাত্র৷ ফলে জোয়ারের লোনা পানি ঢুকে ফসল নষ্ট করছে৷
সিডরে নিজের দুই মেয়েক হারিয়েছেন সদর উপজেলার ছিনইবাড়িয়া গ্রামের মরিয়ম আক্তার৷জাগো নারী নামের একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পায়রাতীরের এ গ্রামের বেড়িবাঁধ কিছুটা মেরামত করা হলেও তাতে জোয়ারের পানি ঠেকছে না বলে জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাঁধ দ্রুত সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণ না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আরো বহু মানুষকে স্বজন হারাতে হবে৷বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সিডরের সময় জেলার ২২টি পোল্ডারের সাড়ে ৯০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ৫৪ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং ৩৯৬ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
এর মধ্যে ২২টি পোল্ডারে ১৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এখনো ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে আছে৷ আংশিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ২১২ কিলোমিটার৷পানি উন্নয়ন বোডের্র উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, জেলার ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের সংস্কার চলছে৷ বাকিটা পর্যায়েক্রমে হবে৷
সিডরের দিন জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলায়৷ ওই এলাকার বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়ি ভেসে যায়৷ হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে পড়ে, নষ্ট হয় রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো৷
এরপর সাত বছর হয়ে গেলেও বলেশ্বর নদের তীরে রায়েন্দা বাজার এলাকা এখনও অরক্ষিত৷সিডরের সময় জলোচ্ছ্বাসে এ বাজারের ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল৷ সিডরের পর ২০০৯ সালের আইলার পানিতেও বাজারটি আবার ভেসে যায়৷এ বাজারের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী বাঁধ মেরামতের দাবি জানিয়ে এলেও প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পাননি৷
অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে রায়েন্দা বাজারকে বাঁধের আওতায় আনতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে৷ বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণও শুরু হয়েছে৷বাজারের উত্তর কদমতলা বাঁধের বাইরে বলেশ্বর নদের তীরের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, বাঁধের বাইরে থাকি বলে পূর্বাভাস পেলেই আমাদের আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়৷ মনে হয় আবার বুঝি নিঃস্ব হয়ে যাব৷ভবিষ্যতে ক্ষতি ঠেকাতে দ্রুত বাঁধ সংস্কারের দাবি জানান বাজারের ব্যবসায়ী স্বপন কুমার নাগ এবং রায়েন্দা বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন৷
আনোয়ার হোসেন বলেন, বলেশ্বর নদের তীরে এ বাজারে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত আড়াই হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ আবহওয়া অফিস সিগন্যাল দিলে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না৷ এই বুঝি আমাদের দোকানে পানি উঠে তলিয়ে গেল৷
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন অভিযোগ করেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত সাত বছরে কয়েকবার বাঁধ নির্মাণের জন্য জরিপ করেছে৷ কিন্তু আজও তা হয়নি৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোডের্র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইন উদ্দিন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড রায়েন্দা বাজারকে বাঁধের আওতায় আনতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে৷ তারই অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে৷
প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সাতবছরেও দক্ষিণ উপকূলের বরগুনা জেলার ক্ষতিগ্রসত্ম বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ ও পুর্ননির্মাণে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়ণি৷ আর প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ উপচে জোয়ারের পানি ফসলি জমি ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে৷ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে লবণাক্ততা৷ফলে, এই অঞ্চলের দশ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় জেলার অগনিত মানুষের জীবন -জীবিকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে৷ যেসব বাঁধ রয়েছে তাও খুব নাজুক হওয়ায় তা বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে উপযোগী নয়৷ অমাবস্যা-পুর্নিমার সময় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে এ অঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ ক্ষতিগ্রসত্ম বাঁধ দ্রম্নত সংষ্কার ও নির্মান না হলে কৃষিনির্ভর এ জেলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে এমনটাই আশংকা করছে এলাকাবাসি৷৷প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় সিডর,আইলা ও মহাসেনে জলোচ্ছ্বাসে এসব জেলার অধিকাংশ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বিলীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ সরকারী তথ্য অনুযায়ী সিডরের আঘাতে বরগুনায় প্রাণ হারায় এক হাজার ৫০১ জন মানুষ৷ গৃহহীন হয়ে পরে জেলার ৮৯হাজার ৭৮৫টি পরিবার৷ সিডরে এত বেশী ক্ষয়ক্ষতির মুল কারণ ছিল বাঁধ ভাঙা পস্নাবন ৷
অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ দিয়ে লোনা পানি ঢোকায় কমে যাচ্ছে আবাদী জমি৷ গত একদশকে বরগুনা জেলায় ১৭ হাজার ৪৪০ হেক্টর, পটুয়াখালীতে ৩৬ হাজার ৩৯০ হেক্টর, ভোলায় ১২ হাজার ৭৭০ হেক্টর ও ঝালকাঠি জেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর আবাদী জমি অনাবাদী হয়েছে৷ তাই দক্ষিনাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামতের দাবী কৃষি কর্মকর্তাদের৷
বরিশাল আঞ্চলিক ধান গবেষনা ইনষ্টিটিউট প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.মো.রফিকুল ইসলাম জানান,উপক্থলে বাঁধ না থাকার কারণে লোকালয়ে লবনাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে৷ ফলে লবনাক্ততার কারণে উত্পাদন ব্যাহত হওযার আশংঙ্কা রয়েছে৷বরগুনার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সুরক্ষায় বর্তমানে বরিশাল বিভাগে ১২৩ টি পোল্ডারের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাঁচ হাজার ১০৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে৷ সবচেয়ে বেশী বাঁধ ক্ষতি হয় বরগুনা জেলার ৷ এই জেলার ২২ টি পোল্ডারের আওতায় ৮৫০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ও ২১২কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রসত্ম রয়েছে৷
ক্ষতিগ্রসত্ম অবকাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অথর্ায়নে ২৬০ কি.মি. বেরীবাধ মেরামত করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৩৮২ কি.মি. বেরীবাধ বিশ্বব্যাংকের অথর্ায়নে ইসিসিআরপি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে৷ এই প্রকল্পের বাসত্মবায়নের কাজ ইতিমধ্যে শুরম্ন হয়েছে৷ ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল৷ এই প্রকল্পের সার্বিক কাজ শেষ হলে বরগুনার জনগনের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করতে সক্ষম হবে৷
বরগুনা সদর উপজেলার বালিয়াতলী,পুরাকাটা, ডালভাঙ্গা, আমতলীর নিশানবাড়িয়া, জয়ালভাঙ্গা, ঘটখালী, পাথরঘাটার পদ্মা,রম্নহিতা ও বেতাগী উপজেলায় ক্ষতিগ্রসত্ম বেরীবাধ রয়েছে৷ এসব এলাকার মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে৷ভাঙ্গা বেরীবাধ দিয়ে এখনো পানি ঢুকে ফসলহানী হচ্ছে৷ সিডর বিধ্বসত্মদের চাপা কান্না এখনো কান পাতলেই শোনা যায়৷ এখন নিম্মচাপের কথা শোনলেই উপকূলের মানুষ আত্কে ওঠে৷
সরেজমিন বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের জন্য মানুষের তীব্র অস্থিরতা৷ একদিকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা অন্যদিকে কৃষি ও মত্স্য নির্ভর এ অঞ্চলের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে ৷ কেননা অধিকাংশ এলাকায় বাঁধ না থাকায় অহরহ জোয়ারের লবন পানি ঢুকে ফসল ও অন্যান্য সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে ৷বরগুনা উপকূলের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা পস্নাবিত হয়৷ পুরনো বাঁধ উপচে পানি ওঠায় এখন বাঁধ আছে এমন এলাকার বাসিন্দারাও নিরাপদবোধ করছেননা৷
বরগুনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন,প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পাওয়ায় দীর্ঘদিনেও ৰতিগ্রস্থ বাধ সংষ্কার ও নির্মান সম্ভব হয়নি, তবে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বরগুনার ১০ টি পোল্ডারে কাজ শুরম্ন হয়েছে ৷
কলাপাড়া :শনিবার সিডর তান্ডবের সাত বছর৷ প্রকৃতির বুরডোজার খ্যাত ঘুর্ণিঝড়ের ভয়াল থান্ডবের সাত বছর পরও কলাপাড়ায় চার সহস্রাধিক পরিবারের ভাগ্যে পুনর্বাসন জোটেনি ৷এসব পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুপড়িতে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে৷ কবে নাগাদ তাদেরকে পুনর্বাসন করা হবে তা সরকারের সংশিস্নষ্ট মহল জানে না৷ উল্টো যাদেরকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল তারও দুই তৃতীয়াংশ ঘর বাস অযোগ্য হয়ে গেছে৷ নতুন করে বেড়েছে গৃহহারা পরিবার৷সুপার সাইক্লোন সিডরের ভয়াল তান্ডবের কথা মানুষ আজও ভোলেনি ৷ ভয়াল ওই তান্ডবে কলাপাড়ায় ৯৪ জন মানুষের প্রানহানি ঘটে ৷ আজও নিখোঁজের রয়েছে সাত জেলে ও এক শিশু৷ আহত হয়েছে ১৬৭৮জন ৷ এর মধ্যে ৯৬ জন প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে৷ বিধবা হয়েছে ১২ গৃহবধু৷ এতিম হয়েছে ২০ শিশু ৷ সম্পুর্ণভাবে ঘর বিধ্বসত্ম হয়েছে ১২হাজার নয় শ’ পরিবার৷ আংশিক বিধ্বসত্ম হয় ১৪ হাজার নয় শ’ ২৫ পরিবার৷ তিন হাজার দুই শ’ ২৫জেলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়৷ শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার ক্ষতির শিকার প্রকৃতির থাবায়৷ এর মধ্যে ৫৪৭৩ টি পরিবারকে ঘর ণিমর্াণ করে দেয়া হয়েছে ৷ ৫৪০ পরিবারের মধ্যে দেয়ার জন্য ব্যারাক হাউস নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে চার বছর আগে৷ কিন্তু এসব ব্যারাকের অনত্মত ২০০ কৰে লোকজন থাকছে না৷ ব্যারাক হাউসের চাল বেড়া পর্যনত্ম চুরি হয়ে গেছে৷ সম্পুর্ণ বিধ্বসত্ম আরও চার সহস্রাধিক পরিবার আজ পর্যনত্ম ঘর পায়নি ৷ আদৌ আর কখনও পাবে কিনা তা খোদ সরকারের মহল থেকে নিশ্চিত করতে পারেনি৷ বসতঘর সম্পূর্ণ বিধ্বসত্ম হওয়া ১২হাজার পাঁচ শ’ ১৬ পরিবারের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া তিন হাজার, আড়াই হাজার, দুই হাজার এবং এক হাজার টাকা করে আরও ছয় হাজার সাত শ’ পরিবারকে গৃহ নির্মাণে সহায়তা দেয়া হয়েছে ৷ গৃহ ণিমর্াণ সামগ্রী দিয়ে সহায়তা দেয়া হয়েছে আরও অনত্মত সাত হাজার পরিবারকে৷ খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে অধিকাংশ পরিবারকে৷ এখবর সরকারের বিভিন্ন সুত্রের ৷ তারপরও সম্পূর্ণ এবং আংশিক বিধ্বসত্ম চার সহস্রাধিক পরিবার আজও মানবেতর জীবন-যাপন করছে৷ এরা তাবুর নিচে, কেউবা ডেড়া তুলে সনত্মান পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছে৷ এছাড়া সিডরে পেশা হারানো অনত্মত অর্ধশত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখনও পেশায় ফিরে যেতে পারেনি৷ সরকারি ভাবে ঝুঁকি হ্্রাস কর্মসূচির মাধ্যমে ৫০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে পাঁচ-দশ হাজার টাকা করে সুদমুক্ত লোন দেয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ৰুদ্র ব্যবসায়ীর ভাগ্যে তা জোটেনি ৷
সিডরের সাত বছর পরও কলাপাড়ায় বিধ্বসত্ম ছয় কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বেহাল দশা কাটেনি৷ বিধ্বসত্ম এ বাঁধ বহুদফা বিভিন্ন আঙ্গিকে মেরামত কিংবা পুনর্বাসন করা হয়েছে৷ কিনত্ম বিধ্বসত্ম দশা কাটেনি৷ ভাঙ্গা বেড়িবাঁধে হাজারো কৃষক ও জেলে পরিবারের কপাল পুড়েছে৷ কিন্তু মেরামত কিংবা পুনর্বাসনের নামে সরকারের দেয়া কোটি কোটি টাকায় কপাল খুলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও সরকারি দলের চিহ্নিত কিছু লোকজনের৷ ফলে ১৩ গ্রামের মানুষের চরম দুরাবস্থা চলছে৷ এসব মানুষের কৃষিউত্পাদন ভেসত্মে গেছে৷ ফসলি জমি অনাবাদি৷ জোয়ারের অস্বাভাভিক চাপে সব বিধ্বসত্ম হয়ে গেছে৷ লালুয়ার মুন্সিপাড়া থেকে পশুরবুনিয়া এবং মহিপুরের নিজামপুর এলাকায় বাঁধ বিধ্বসত্ম থাকায় মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে গেছে৷ অনত্মত চার হাজার কৃষক পরিবার বছরের পর বছর আমন আবাদ করতে পারেনি৷ পারেনি আউশ, বোরো কিংবা রবিশস্যের আবাদ করেতে৷ অভাবের তাড়নায় কর্মসংস্থানের খোঁজে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে অনত্মত ৪০টি পরিবার৷ বাড়িঘর ছেড়ে বেড়িবাঁধের সস্নোপে আশ্রয় নিয়েছে অর্ধশত পরিবার৷ শিশুরা লেখপড়া ছেড়ে ঠেলছে জীবিকার চাকা৷
বিধ্বসত্ম বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবিতে হাজার-হাজার নারী-পুরম্নষ বহুবার কলাপাড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের সামনে মানববন্ধন, বিৰোভ সমাবেশ করেছেন৷ দিয়েছেন উর্ধতন কতর্ৃপৰের কাছে স্মারকলিপি৷ কিন্তু কোন কিছুই হয় নি৷ রামনাবাদ পাড়ের চারিপাড়া, চৌধুরিপাড়া, নয়াকাটা, মঞ্জুুপাড়া, মুন্সিপাড়া, ছোট পাঁচ নং, বড় পাঁচ নং, নিজামপুরসহ ১৩টি গ্রামের মানুষের এমন দুরাবস্থা চলছে৷ বছরের পর বছর এরা পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে৷ রোজার মাসে না খেয়ে সেহরি-ইফতারি করেছেন৷ ঈদ-কোরবানী কিছুই করতে পারেনি৷ বাড়িঘরের লাগানো গাছপালা পর্যনত্ম পচে গেছে৷ এসব দুর্ভোগ এখন আর মানুষ বলতে চায়না, ভুলতেও পারছে না৷ সব হারানো স্মৃতি রোমন্থন করেন৷ তবে পাউবো’র এসও কামাল হোসেন ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কামাল বঙ্্রের নাম দুর্গতরা আজও ভোলেন নি৷ কারণ চান্দুপাড়া থেকে চারিপাড়া পর্যনত্ম আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামতের তদারকি করত ওই দুই কর্মকর্তা৷ এ দুজনের হরিলুটের কথা ছোট-বড় সবাই অবগত৷
লালুয়ার ৪৭/৫ পোল্ডারের বিধ্বসত্ম বাঁধ মেরামত কিংবা পুনর্বাসনের জন্য ২০১০-২০১২ অর্থ বছরে ১৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়৷ বরগুনার এক ঠিকাদার এ কাজটি করেন৷ কাজটির শুরম্নতেই মূল ডিজাইন মানা হয় নি৷ বাঁধ পুনর্বাসনের মূল ডিজাইন ছিল টপ দুই দশমিক ৪৭ মিটার৷ উচ্চতা আর এল এবং ফরমেশন লেভেলে পাঁচ দশমিক ৭৯ মিটার৷ এছাড়া রিভার সাইটের এক ফুট উচু করলে সস্নোপ হবে পাঁচফুট এবং কান্ট্রি সাইটে এক ফুট উচু করলে দুই ফুট সস্নোপ দেয়ার কথা ছিল৷ এসবের কিছুই মানা হয়নি৷ উল্টো উচু বাঁধের সস্নোপ কেটে খাড়া এবং টপ কেটে আরও নিচু করা হয়েছে৷ এ কাজটি ২০১২ সালের মে মাসে শেষ করা কথা থাকলেও বহু পরে আগাছোলা অবস্থায় শেষ হয়৷ স্থানীয় লোকজন বহুবার বহু অভিযোগ দিয়েছেন৷ কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্ধতন প্রকৌশলী কিংবা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কেউ কর্ণপাত করেনি৷
রিয়াজ হাওলাদার জানান, বাঁধের ১০০ ফুট কাজের জন্য তাদেরকে দেয়া হয়েছে ১২-১৩ হাজার টাকা৷ রিপন হাওলাদার জানান, সরল রাসত্মার উপরে এক ফুট মাটি দেয়া হয়েছে৷ পারভেজ জানালেন, রাসত্মা মেরামত নয়৷ খালি খাওন জোগাড় করছে৷ মনির সরদার জানান, এক বিলাসত্ম মাটি দেয়া হয়েছে৷ দুই দিকের পুরান ঢাল ছেচে দেয়া হয়েছে৷ ইউপি মেম্বার মজিবর রহমান জানান, ৬০ এর দশকে যে উচ্চতায় বেড়িবাঁধ করা হয়েছে৷ পরবর্তিতে যতবার মেরামত কিংবা বাঁধ পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে কখনই মূল ডিজাইন ঠিক রাখা হয় নি৷ জেলে মেছের মোলস্না প্রশ্ন করেন, জোয়ারে পানি কত বাড়ছে ? পুরান বাঁধ ডোবে নাই ক্যান ? তার দাবি- এমন বেশি পানি আগেও হয়েছে৷ বেড়িবাঁধের ডিজাইন ঠিক না থাকায় তাদের এমন সর্বনাশ হয়ে গেছে৷
একই অভিযোগ নিজামপুর গ্রামের পানিবন্দী মানুষের৷ তাদের সুস্পষ্ট অভিযোগ গত ৫/৬ বছর এ পোল্ডারের বাঁধটি মেরামতের নামে মাত্র মাটি ফেলে ফাতড়ার বনাঞ্চলের কয়েকটি ছইলা-কেওড়া গাছ কেটে সরকারি দলের নেতারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসওদের ম্যানেজ করে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছে৷ কখনও ডিজাইন ঠিক রাখা হয় নি৷ বস্নক ফেলা হয়েছে নিম্নমানের৷ নাম সর্বশ্ব৷ যারা এসব জরম্নরি মেরামত যারা করেছে তাদের খুঁেজ শাসত্মির ব্যবস্থা করা হোক৷ বর্তমানে এ বছর বাঁধ বিধ্বসত্ম হওয়ার পরে জরম্নরি কাজ করতেও আগ্রহ নেই ওই চিহ্নিত লুটেরাদের৷ এভাবে শুধুমাত্র দুনর্ীতিবাজ কর্মকর্তা ও লুটেরা ঠিকাদারদের কারণেই কলাপাড়ার লালুয়া ও মহিপুরের নিজামপুরের প্রায় আড়াই হাজার কৃষক পরিবারের সর্বনাশ হয়ে গেছে বলে সকলের মতামত৷
শুধুমাত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েক প্রকৌশলী এবং সরকারি দলের চিহ্নিত ১০/১২ প্রভাবশালী নেতার দুনর্ীতির শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে হাজার হাজার কৃষক ও জেলে পরিবার৷ বিপদাপন্ন এসব মানুষ তাদের দুর্দশা সিডরের সাত বছর পরেও কাটাতে পারেনি৷ তারা প্রধামন্ত্রীর হসত্মৰেপ কামনা করেছেন৷ সবার দাবি তাদেরকে জোয়ারের তান্ডব থেকে রৰায় স্থায়ী প্রটেকশনের বাসত্মব সম্মত পদৰেপ নেয়া হোক ৷ লালুয়ার চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান জানান, ৪৭/৫ নম্বর পোল্ডারের বেড়িবাঁধ বিধ্বসত্ম হয়ে এখন ১৩টি গ্রামের ২৩৭৬ পরিবারের জীবন ও সম্পদ এখন চরম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছে৷ ইতোমধ্যে ৩০টি ঘরবাড়ি সম্পুর্ণভাবে বিধ্বসত্ম হয়ে গেছে৷ আংশিক বিধ্বসত্ম হয়েছে আরও ২১৮৫টি বাড়ি৷ কবে, কীভাবে এ বিপদ তারা কাটাতে পারবেন তাও জানেন না৷ পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়াস্থ নির্বাহী প্রকৌশল দফতরের দেয়া তথ্যমতে সিডরে ৭০ দশমিক ০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বসত্ম হয়৷ যার মধ্যে ২৯ কিলোমিটার সম্পুর্ণ বিধ্বসত্ম হয়৷ এর মধ্যে অধিকাংশ বিধ্বসত্ম বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে৷ লালুয়া ও নিজামপুরের মোট ছয় কিলোমিটার বিধ্বসত্ম বেড়িবাঁধ মেরামত করতে উর্ধতন কতর্ৃপক্ষকে বার বার তাগিদ দেয়ার কথা জানালেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফি উদ্দিন৷ প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করবেন৷