দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩নভেম্বর: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পলাতক রাজাকার জাহিদ হোসেন খোকনকে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দিয়েছে আনর্্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল৷বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন৷
খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টিই প্রমাণিত হয়েছে, বাকি একটি প্রমাণিত হয়নি৷ এর মধ্যে ৬টি অভিযোগে তাকে মৃতু্যদণ্ড ও ৪টি অভিযোগে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড আর প্রমাণিত না হওয়ায় একটি অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়৷এর মধ্য ৫,৬,৭,৮,৯,১০ নম্বর অভিযোগে দুই বছরের বুলু খাতুনসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবু্যনাল৷ ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত ৪টি অভিযোগে আরও ৪০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ফরিদপুরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা খোকন রাজাকারকে৷রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীভী বলেন, পলাতক থাকায় আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইবু্যনাল৷তবে এ রায়ে ন্যায় বিচার পাওয়া যায়নি বলে জানান আসামি পক্ষের আইনজীবীরা৷
আদালত ছয়টি অভিযোগে মৃতু্যদণ্ড প্রদান করে আদেশে বলেন, পলাতক খোকনকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃতু্যদণ্ড কার্যকর করতে হবে৷এজন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেবে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী৷রায় ঘোষণার পর এ মামলার প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, স্বঘোষিত রাজাকার জাহিদ হোসেনের ওরুফে খোকন রাজাকারের বিরম্নদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে প্রসিকিউশন৷ এ আসামির সর্বোচ্চ শাসত্মি মৃতু্যদন্ড হওয়ায় সনত্মোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় খোকন রাজাকারের হাতে ভিকটিমদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে৷
প্রসিকিউটর বলেন, তার বিরম্নদ্ধে আনীত ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে৷ এরমধ্যে হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণ সংক্রানত্ম ৬টি অভিযোগে তাকে ফাঁসির আদেশ (মৃতু্যদন্ড) এবং বাকী ৪ অভিযোগে মোট ৪০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে৷ এ আসামি একক ও সম্মিলিতভাবে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বলে রায়ের পর্যবেৰণে উর্লেখ করা হয়৷মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, এ রায় আইনের শাসনের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে আরো একটি ধাপ অগ্রগতি হলো৷ পলাতক এ আসামিকে গ্রেফতার করে রায় কার্যকরের পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইবু্যনাল৷
এর আগে গত ১৭ এপ্রিল আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল মামলাটির যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার আদেশ দেয়৷গত বছরের ২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যনত্ম মামলার তদনত্ম কর্মকর্তা (আইও) সত্যরঞ্জন দাশসহ খোকন রাজাকারের বিরম্নদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪ জন৷ গত বছরের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের হয়ে কাজ করা খোকন স্বাধীনতার পর বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান৷ তিন বছর আগে নির্বাচনে জিতে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র বনে যান ৬৬ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধী৷ যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বৃহস্পতিবার এই পলাতক যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করেন৷
এ ট্রাইবু্যনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকও এ সময় উপস্থিত ছিলেন৷১০৯ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়, জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১১টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়েছে৷এর মধ্যে ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগি্নসংযোগের দায়ে ফাঁসির রায় এসেছে৷ এছাড়া ২, ৩, ৪ ও ১১ নম্বর অভিযোগে আটক, ধর্ষণ, ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করা, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পরামর্শ ও সহযোগিতার দায়ে আসামিকে মোট ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷
জাহিদ হোসেন খোকনকে গ্রেপ্তার বা তার আত্মসমর্পণের পর এই সাজা কার্যকর হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক৷ এই রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে৷ তবে সেই সুযোগ নিতে হলে খোকন রাজাকারকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে৷ ট্রাইবু্যনালে এ পর্যন্ত আসা ১২টি রায়ের মধ্যে তিনটি মামলায় মোট চারজন পলাতক আসামির সর্বোচ্চ সাজা হলো৷
ট্রাইবু্যনালের প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং নবম রায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ফাঁসির আদেশ আসে৷ পলাতক থাকায় তারা কেউ আপিলের সুযোগ পাননি৷যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরুর পর থেকেই পলাতক খোকন এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে৷ তবে সুইডেনপ্রবাসী বাংলাদেশিদের তথ্য অনুযায়ী, সেখানেই বড় ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে বহাল তবিয়তে রয়েছেন খোকন৷
রাজাকার কমান্ডার থেকে জনপ্রতিনিধি: ফরিদপুরের নগরকান্দার মোতালেব মিয়া ও জয়নব বেগমের দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে জাহিদ হোসেন খোকন দ্বিতীয়৷ তার বড় ভাই জাফর হোসেনও একাত্তরে একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন, যিনি চাঁদহাটের যুদ্ধে ধরা পড়ে জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের পিটুনিতে নিহত হন৷
এ মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী৷ জাহিদ হোসেন খোকন ও তার বড় ভাই জাফর সে সময় মোহাম্মদ আলীর পক্ষে কাজ করেন৷একাত্তর সালের ২১ এপ্রিল নগরকান্দায় পাকিস্তানি বাহিনী এলে খোকন ও তার ভাই জাফর তাদের অভ্যর্থনা জানায়৷ এরপর জাফরের নেতৃত্বে একটি এবং মাওলানা আবুল কালামের নেতৃত্বে আরেকটি মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়৷
এ দুই বাহিনী পরে নগরকান্দার হিন্দুদের এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থকদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় বলে আদালতকে জানান কাশেম৷স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী,মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় খোকন ছিলেন আনসার সদস্য৷ফরিদপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১ সালের দশ মাস এবং মুক্তিযোদ্ধা মো. সোলায়মান আলীর লেখা মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে নগরকান্দার রাজাকার বাহিনীকে সুসংগঠিত করে তোলেন খোকন ও তার ভাই জাফর৷ আর এ কাজে তারা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের কাছ থেকেও সহযোগিতা পেতেন৷ পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সে সময় খাড়াদিয়ায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন বাচ্চু, যা খাড়াদিয়ার মিলিটারি নামে পরিচিতি পায়৷
প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৯ মে চাঁদহাটে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়৷ সেই যুদ্ধে জাফর নিহত হলে নগরকান্দা রাজাকার বাহিনীর প্রধান হন তার ভাই খোকন৷নগরকান্দা সদরের কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মো. রফিকুজ্জামান অনু বলেন,”জাহিদ হোসেন খোকন বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই বলেছেন যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কমান্ডার ছিলেন৷ এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধও ছিল৷
স্বাধীনতার পর খোকন আত্মগোপনে যান এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খোকন এলাকায় ফেরেন৷সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবু সাঈদ খানের লেখা মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস- তৃতীয় খণ্ডে বলা হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে দালাল আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল৷
মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াতঘনিষ্ঠ খোকন বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান জিয়াউর রহমানের আমলে৷ সর্বশেষ নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি হন৷ সেই সূত্রে ২০১১ সালে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি৷এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরু হলে মেয়র হিসাবে শপথ নেওয়ার পরপরই নিরুদ্দেশ হন জাহিদ হোসেন খোকন৷ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরুর পর সরকার তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করে৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় নগরকান্দায় ব্যাপক লুটপাট ও হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করেন খোকন ও তার ভাই জাফর, যা ট্রাইবু্যনালে দেওয়া সাক্ষীদের বক্তব্যেও উঠে এসেছে৷নগরকান্দা পৌর শহরে তার একটি তিন তলা বাড়ি ছাড়াও বিপুল পরিমাণ জমিজমা রয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান৷
খোকনের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম, মেজ ছেলে লেনিন ও ছোট ছেলে পলিন দেশে থাকলেও ওই বাড়িতে থাকেন না৷ বড় ছেলে খায়রুজ্জামান লিংকন সুইডেন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক৷খোকনের এক মেয়েও স্বামীর সঙ্গে স্টকহোমে থাকেন বলে সুইডেনপ্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক সৈয়দ আমিনুল এহসান জানান৷তিনি বলেন,জাহিদ হোসেন খোকন এখন সুইডেনেই আছেন৷ কয়েক দিন আগেও তাকে মেয়ের জামাই বদিউজ্জামান বদির সঙ্গে স্টকহোমে দেখা গেছে৷
মামলার পূর্বাপর: ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে গত বছরের ২৮ মে পর্যন্ত জাহিদ হোসেন খোকনের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করে প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়৷ এরপর ২৯ মে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়৷গত বছর ১৮ জুলাই অভিযোগ আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইবু্যনাল৷
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হলে আদালতের নির্দেশে খোকনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি টওকাশ করা হয়৷ এরপরও তিনি হাজির না হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই আদালত মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলে৷ পলাতক খোকনের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে আব্দুস শুকুর খানকে আইনজীবী নিয়োগ দেন বিচারক৷গতবছর ৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে খোকন রাজাকারের বিচার শুরু করে ট্রাইবু্যনাল৷২১ নভেম্বর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন দাসসহ ২৪ জন সাক্ষ্য দেন৷ আসামি পলাতক থাকায় তার পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিল না৷এরপর দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৭ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইবু্যনাল৷
দ্বাদশ রায়: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইবু্যনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়৷ ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে৷ পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি৷৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ৷
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইবু্যনাল আইনে সংশোধন আনে৷ এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়৷ গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে টওাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর৷ ট্রাইবু্যনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ৷
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর দেইল্যা রাজাকার নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃতু্য কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷গতবছর ৯মে ট্রাইবু্যনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলমোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃতু্যদণ্ড দেয় ট্রাইবু্যনাল৷ ওই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষের আপিল শুনানি শেষে গত ৩ নভেম্বর দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ৷মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইবু্যনাল৷ এটি ছিল ট্রাইবু্যনালের পঞ্চম রায়৷
রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু৷গতবছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃতু্যদণ্ড দেওয়া হয়৷ এরপর ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাবেক সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে৷ তারাও রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন৷গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম৷ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি৷
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃতু্যদণ্ড দেয় ট্রাইবু্যনাল৷ তারা দুজনেই পলাতক৷দশম রায়ে গত ২৯ অক্টোবর জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়৷ একাদশ রায়ে গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকেও আদালত মৃতু্যদণ্ড দেয়৷ জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে৷