high_court

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৯নভেম্বর: সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট৷ রোববার এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন৷মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন সচিব ও সংসদ কার্যালয়ের সচিবকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে৷

সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবীর দায়ের করা ওই রিট আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন এডভোকেট মনজিল মোরসেদ৷রাষ্টপক্ষের শুনানী করেন ডেপুটি এর্টনী জেনারেল মোতাহার হোসেন রাজু৷ গত ৫ নভেম্বর অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী,অ্যাড. ইমরান কাওসার,অ্যাড মাসুম আলীম, অ্যাড এখলাস উদ্দিন ভূইয়া, অ্যাড মো: সারোওয়ার আহাদ চৌধুরী, অ্যাড মাহবুবুল ইসলাম, নূরুল ইসলাম বাবুল, অ্যাড শাহীন আরা লাইলি ও অ্যাড রিপন বাড়ৈ এ রিটটি দায়ের করেন৷পরে এডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদেও জানান,সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী কেন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট৷এ রায়ের ফলে বিচারকদের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে তাই এ রিট করা হয়েছে৷ তিনি আরো বলেন, বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিল৷ এটি নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিলনা ৷ তারপরেও সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এ ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া হয়েছে৷

এডভোকেট মনজিল মোরসেদ আরো বলেন,এ সংশোধনীতে কোন অসত্‍ উদ্দেশ্য থাকতে পারে৷ প্রতক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আদালতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এ সংশোধনী করা হতে পারে৷গত সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাসের মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও আইনজীবীদের একটি পক্ষ শুরু থেকেই সরকারের এ উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছিল৷প্রসঙ্গত, গত ১৭সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয়৷ রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সম্মতি দেয়ার পর ২২ সেপ্টেম্বর এটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয়৷ এতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়৷

গত ২২ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিলে সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ৷ এর মাধ্যমে বিলটি আইনে পরিণত হয়৷ এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ৩২৭ জন সংসদ সদস্যের বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে পাস হয় ষোড়শ সংবিধান সংশোধন বিল-২০১৪৷ এ বিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ছিল৷ পরবর্তীতে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বিধানটি বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে এই ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়৷গত ১৮ আগস্ট সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী-সংক্রান্ত বিল মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়৷ এ বিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই ছিলো৷ পরবর্তীতে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বিধানটি বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে এই ক্ষমতা ন্যসত্ম করা হয়৷এর মধ্য দিয়ে ৪০ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত হলো৷

বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে৷শেষ পর্যন্ত সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের বিপুল হর্ষধ্বনি এবং দফায় দফায় টেবিল চাপড়ানোর মধ্য দিয়ে বিলটি পাস হয়৷ বিল পাসের সময় সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টি-জেপির সভাপতি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন সংসদে উপস্থিত ছিলেন না৷বিল-সম্পর্কিত আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অঙ্গীকার করে বলেন,শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকদের নিয়োগ বিধিমালা নিশ্চয়ই করবে৷ আইনমন্ত্রী বিলটি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য স্পিকারের অনুমতি প্রার্থনা করেন৷ এরপর বিলের ওপর দেওয়া নোটিশ নিষ্পত্তি শেষে তা বিভক্তি ভোটে পাস হয়৷ বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৩২৭টি, বিপক্ষে কোনো ভোট পড়েনি৷ এর আগে বিলের দফা ও সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বিভক্তি ভোট হয়৷ তা ৩২৮-০ ভোটে পাস হয়৷ বিলটি পাস হতে সময় লেগেছিল মোট তিন ঘন্টা ৩১ মিনিট৷ ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হতে সময় লেগেছিল তিন ঘন্টা পাঁচ মিনিট৷

বিলটি পাসের আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব কন্ঠভোটে নাকচ হয়৷ জনমত যাচাইয়ের বিষয়টি ভোটে দেওয়া হলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদসহ নোটিশদাতাদের অনেকেই তাঁদের নোটিশের বিপক্ষে ভোট দেন৷ এ নিয়ে সরকারি দলের সাংসদেরা কিছুক্ষণ হাসাহাসিও করেন৷৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন৷ পরে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল৷পাস হওয়া বিলে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দফা ২-এ বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামথ্যর্ের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠ সদস্যের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণ করা যাবে৷

৩ দফায় বলা হয়েছে, সাংসদদের প্রস্তাব-সম্পর্কিত এবং বিচারকের অসদাচরণ ও অসামথর্্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷ ৪ দফায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন৷এর আগে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত হয়েছিল৷ এরপর সামরিক ফরমানের দ্বারা পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়৷ প্রধান বিচারপতি ও অপর দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নিয়ে জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়৷

২০১২ সালে সগক ভবনকে কেন্দ্র করে আদালতের একটি রায় নিয়ে সংসদে বিরূপ সমালোচনা হয়৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারক সংসদ ও স্পিকারকে নিয়ে মন্তব্য করলে সেই সময় সাংসদদের অনেকেই বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার দাবি তোলেন৷ এ নিয়ে স্পিকার পরে একটি রুলিংও েেদন৷বিলের উদ্দেশ্য ও কারণসংবলিত বিবৃতিতে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারকের অসদাচরণ বা অসামথর্্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে৷ আইন অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না৷ বিলটি আইনে পরিণত হলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে৷বিলের ওপর আলোচনা: বিলের ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, মহাসচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী, রওশন আরা মান্নান, নুরুল ইসলাম, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি মো.সেলিম,তাহজীব আলম সিদ্দিকী ও আবদুল মতিন৷

বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি মো. সেলিম, তাহজীব আলম সিদ্দিকী, আবদুল মতিন, জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী ও রওশন আরা মান্নান এবং বিএনএফের আবুল কালাম আজাদ৷এ-সম্পর্কিত আলোচনায় বেশির ভাগ সদস্য বলেন, বিলটি তড়িঘড়ি করে আনা হয়েছে৷ তাই এ বিষয়ে জনমত নেওয়া দরকার৷ রওশন এরশাদ বলেন, যাঁরা সংবিধানে এই অনুচ্ছেদটি জুড়েছিলেন, তাঁরাই এখন এর বিরোধিতা করছেন৷ জনমনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ আগেই বিচারপতি নিয়োাগের আইন করা হলে ঝামেলা কমে যেত৷আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার পক্ষে নই৷ এক বালতি দুধে খারাপ কিছু পড়লে পুরো দুধই নষ্ট হয়ে যায়৷ বিচার বিভাগ নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন, আমরা তাঁদের রক্ষা করতে চাই৷ তাঁদের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চাই৷ বিলটি নিয়ে মন্ত্রিসভা ও সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে৷ সুতরাং জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই৷বিলটির ওপর বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ এবং স্বতন্ত্র ১৫ জন সদস্য মোট ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন৷