দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৯নভেম্বর: জামায়াতে ইসলামীর নেতা মোহাম্মাদ কামারুজ্জামানে মৃতু্যদণ্ডাদেশ অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ একইসাথে মৃতু্যদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানকে আপিলের সুযোগ দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি৷ রোববার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়৷
রায় কার্যকরের প্রস্তুতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, কামরুজ্জামানের মৃতু্যদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রস্তুতিতে নিতে বাংলাদেশ সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারকে যে নির্দেশ দিয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ রায় ঘোষণার পরপরই কামরুজ্জামানকে ঢাকা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়৷ এটা প্রমাণ করে তার রায় দ্রুত বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে৷ মৃতু্যদণ্ডের মামলার প্রক্রিয়া অনুযায়ী কামারুজ্জামান ও তার আইনজীবীদের এখনো পূর্ণাঙ্গ রায়ের লিখিত কপি হাতে পেতে হবে৷ রায় হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তার রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন৷ সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন যে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি হাতে পাবার আগেই রায় কার্যকর করা যেতে পারে৷ এটি মৃতু্যদণ্ডের মামলার নীতির পরিপন্থী৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেন, সব সময়ই মৃতু্যদণ্ডের রায়ের বিরোধিতা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ মৃতু্যদণ্ড একটি অপূরণীয় ক্ষতি, মর্যাদা হানিকর এবং নিষ্ঠুর অবিচার৷তিনি বলেন, সমস্যাটা অধিকতর গুরুতর আকার ধারণ করে যখন, যখন বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ মান বজায় রাখা হয় না৷ যখন আদালতে মৃতু্যদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা যায় না তখন তা সমস্যার সৃষ্টি করে৷বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের রাজনৈতিক মামলায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমার মাধ্যমে কৌশলে মৃতু্যদণ্ড বন্ধ করা যায়৷
১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের এক আদেশে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ২০১০ সালের জুলাই মাসে আটক করা হয়৷ বিচারবহির্ভূত গ্রেফতার নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপ জানিয়েছে, কামারুজ্জামানকে গ্রেফতারের সময় তাকে কোনো ধরনের কারণ জানানো হয়নি৷ তার গ্রেফতার ছিল বিচারবহির্ভূত এবং এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন৷
ত্রুটিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন বিচারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনাল ২০১৩ সালের মে মাসে কামারুজ্জামানকে মৃতু্যদণ্ডের আদেশ দেয়৷ সোহাগপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় অন্যায়ভাবে সাধারণ নাগরিক হত্যার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করে ট্রাইবুনাল৷ ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায়েও ট্রাইবুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়৷ এক সপ্তাহে দেয়া মৃতু্যদণ্ডের রায়ের মধ্যে কামরুজ্জামানেরটা ছিলো তৃতীয়৷
ট্রাইবুনালের বিচারে ত্রুটি রয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালে কামারুজ্জামানসহ যাদের বিচার কাজ হয়েছে সেগুলো ন্যায় বিচারের ঘাটতি আছে৷ কামারুজ্জামানের মামলায় আসামিপক্ষের প্রমাণ, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য ও প্রমাণ ছিল অযৌক্তিক মাত্রায় কম৷ দুই বিচারককে পক্ষপাতের জন্য বাদ দেয়ার আবেদন করা হলে তাও খারিজ হয়ে যায়৷ আর এ বিষয়টি অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে খারাপ নজির তৈরি করে৷ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তড়িত একটি অতীত-সম্পর্কীয় আইনে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়া হয়, যেটি আন্তার্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ৷
বিবৃতিতে বলা হয়, অপর আরেক অভিযুক্ত আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, তার প্রধান সাক্ষীকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উঠিয়ে নিয়ে গেছে৷ এরপরও তাকে এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ আসামি সাক্ষী অপহরণের ঘটনায় কোনো তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ট্রাইবু্যনাল৷ প্রসিকিউশন ও বিচারকদের মধ্যে হস্ত ক্ষেপের কারণে অধিকাংশ বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ যারা ট্রাইবু্যনালের বিচারের বিপক্ষে কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়৷ আর এটি করা হয় যাতে করে নিজেদের ত্রুট এড়ানো যায় এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়া যায়৷ ট্রাইবু্যনালকে নিয়ে সমালোচনা করার দায়ে সাংবাদিক ডেভিড বার্গমেন এবং ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে আদলাত অবমাননার অভিযোগ এনেছে ট্রাইবু্যনাল৷
বিবৃতিতে বলা হয়, মৃতু্যদণ্ডের রায় বাস্তবায়নের চাইতে স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়াকেই অধিক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ অন্যায় বিচার প্রক্রিয়ায় কাউকে মৃতু্যদণ্ড দেয়া হলে তা হবে ন্যায় বিচারের অধিকার রক্ষার লঙ্ঘন৷
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করার জন্য আবারো বাংলাদেশেরে প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ আর্টিকেল ৪৭ এ(১) অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তরা তাদের মৌলিক অধিকার পাবে, তাদের বিচার হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে এবং তাদের অধিকারের জন্য আদালতে আইনি সুবিধা পাবে৷
ব্যাড অ্যাডামস বলেন,১৯৭১ সালে সংঘটিত অন্যায় ও সন্ত্রাসের জন্য ন্যায় বিচারকে সমর্থন করে হিউম্যান রাইটস৷ তবে আমরা বারবারই বলে আসছি, ভোক্ত-ভোগীদের ন্যায়বিচারের জন্যই ট্রাইবু্যনালের মান আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে৷তিনি বলেন, বিচারের জন্য উচ্চ পর্যায়ের মান বজায় রাখা উচিত, বিশেষ করে যখন সেটাতে জীবনের প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়৷ মৃতু্যদণ্ডের রায় অপূরণীয়, নিষ্ঠুর৷ বাংলাদেশকে এ থেকে চিরতরে বের হয়ে আসা উচিত৷
প্রসঙ্গত, এর আগে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা কামারুজ্জামানের মৃতু্যদণ্ডাদেশ স্থগিতের আহ্বান জানায়৷